আনিসুল হক

আমাদের কাঁদতে দিন

১ জুলাই ২০২০

ফারাজ আইয়াজ হোসেন

ফারাজ আইয়াজ হোসেনের ছবির দিকে তাকাতে পারি না। মাত্র বিশ বছর বয়সের এই তরুণের মুখ থেকে শৈশবের লালিত্য এখনো যায়নি। মাত্র সেদিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি এসেছিলেন প্রথম আলো অফিসে, ইফতার মাহফিলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর মা সিমিন হোসেন প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া স্টার লিমিটেডের একজন পরিচালক। তাঁর নানা জনাব লতিফুর রহমান প্রথম আলোর প্রধান উদ্যোক্তা। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের কক্ষে বসে আমরা গল্প করছিলাম, আমাদের বসার জায়গা করে দেওয়ার জন্য ফারাজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর তাঁর ভাইদের সঙ্গে চাপাচাপি করে একই আসন ভাগ করে নিয়েছিলেন। আমেরিকায় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ছেন তিনি, ছুটিতে এসেছেন দেশে। তাঁর ফেসবুকের দেয়ালে দেখি মায়ের সঙ্গে ছবি, ছবিতে বাংলাদেশ লেখা আর বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা জুড়ে দেওয়া। আমেরিকায় পড়েন, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে বাংলাদেশ।

তাঁদের একজন বন্ধু এসেছিলেন আমেরিকা থেকে, শুক্রবারেই দুপুরে। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে তিনি গিয়েছিলেন গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে।

ফেসবুকে এখন দেখছি আবিন্তা কবিরের চশমা পরা হাসিমুখটাও। তিনিও কিশোরী। ২৭ জুন আমেরিকা থেকে দেশে আসেন তিনি, দেশে ঈদ করবেন বলে।

ভারতের মেয়ে তারুশি জৈনের হাসিভরা মুখটাও দেখি।

এঁরা সবাই আমার সন্তানের বয়সী। এঁরা সবাই আমার কিশোর আলোর পাঠকের সমান বয়সী।

ইশরাত আকন্দ অনুরাগিণী ছিলেন চিত্রকলার। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ। এর আগে কাজ করেছেন গ্রামীণফোনেও। তাঁর বন্ধুরা ফেসবুকে লিখছেন, তিনি ছিলেন প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ব্যক্তিত্ব। ফেসবুকে তিনি সর্বশেষ পোস্ট করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলার কারাগারের ওপরে একটা ভিডিও। জড়িত ছিলেন আর্ট গ্যালারির সঙ্গে। চুলে ফুল গোঁজা তাঁর ছবিটা দেখলে মনে হয়, আস্ত একটা চাঁপা ফুল ফুটে আছে পর্দাজুড়ে।

এঁরা কেউ আর ফিরে আসবেন না।

আমরা আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে পারছি না। আমাদের কোল থেকে আমাদের সন্তানদের কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। হাতের মুঠো থেকে ছুটে যাচ্ছে আমাদের স্নেহের সন্তানদের হাত।

এত রক্ত! এত রক্ত!

 

ওই রেস্তোরাঁর রান্নাঘরের মেঝে ভেসে আছে টকটকে লাল রক্তে। ঘাতকদের পাঠানো ছবিই প্রকাশ করেছে তাদের সমর্থনকারী ওয়েবসাইট। কম্পিউটারের পর্দায় সেই ছবির দিকে তাকালে কে স্থির থাকতে পারবে?

 

গতকাল দুপুরে গিয়েছিলাম ফারাজদের গুলশানের বাড়ির সামনে। তাঁর মা সিমিন হোসেনের সঙ্গে দেখা করার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। দেখা হলে কী বলব? তিনি প্রথম আলোর সাংবাদিককে বলেছেন, আমার ফারাজকে এনে দিন।

 

আমরা কিছুই পারি না। ‘মা, আমি এক ঘণ্টা পরে আসছি’, বলে যে ছেলে বা মেয়ে বাড়ির কাছের রেস্তোরাঁয় যাচ্ছেন, তাঁকে আমরা এনে দিতে পারছি না তাঁর মায়ের কাছে! অথচ উত্তর গুলশান নাকি বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপত্তায় ঘেরা জায়গা। ওই রেস্তোরাঁর এপাশে দূতাবাস, ওপাশে দূতাবাস!

 

মাত্র কদিন আগে একটা সেমিনারে এগিয়ে এলেন একজন তরুণী। এসে বললেন, আমি দীপনের স্ত্রী। জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সল আরেফিন দীপন। এবার আমার কাঁদবার পালা। দীপন আমার প্রকাশক। তিনি আমার কবিতাসমগ্র বের করেছেন। পরের বছর বের করেছেন প্রেমের গল্প। আমি দীপনকে কোনো দিন হাসিমুখ ছাড়া দেখিনি। দীপন বোধ হয় কোনো দিন কোনো পিঁপড়াও পায়ে দলে মারেননি। এই রকম একটা অজাতশত্রু মানুষকে পড়ে থাকতে হলো জমাট বাঁধা রক্তের মধ্যে। দীপনের বিধবা তরুণী স্ত্রীকে দেখে আমি কাঁদতে লাগলাম।

 

পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে পড়াশোনা করেছেন। সাহিত্যপ্রেমিক মানুষটির হৃদয় ছিল বিশাল। তিনি মানিকগঞ্জের গ্রামে প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল খুলেছেন। ২৪ রোজার দিনেও বাচ্চাদের জন্য ঈদের নতুন কাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামে। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর সন্তান জন্ম নেবে, বাবা তখন থাকবেন না।

 

এত রক্ত কেন? এত অশ্রু কেন? কলকাতার গায়ক কবির সুমনের একটা গান আছে ‘কত হাজার মরলে পরে বলবে তুমি শেষে, বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে?’ আর কী হলে আমরা স্বীকার করব, আমরা ভালো নেই। আর কতজন মানুষ মারা গেলে আমরা স্বীকার করব, নিরাপত্তা বলতে আমাদের আর তেমন কিছু নেই।

 

কে এখন নিরাপদ এই দেশে? যে মানুষগুলো শুক্রবার সন্ধ্যায় গুলশানের ওই রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন, তাঁদের কার কী অপরাধ? বিদেশিরা তো এই দেশে অতিথি। বাংলাদেশ তো বিখ্যাত অতিথিপরায়ণতার জন্য। এই দেশ থেকে বিদেশি অতিথিরা ফিরে যাওয়ার সময় চোখ মোছেন, আর বলেন, এই সুন্দর দেশে সবচেয়ে ভালো লেগেছে এই দেশের মানুষদের আতিথেয়তা। বাংলাদেশ কবে থেকে বিদেশিদের জন্য বিপজ্জনক দেশ হয়ে উঠল?

 

হত্যার মিছিল তো থামছে না। প্রায় নিয়মিত চাপাতির কোপে মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। এখন মনে হচ্ছে, এইটাই স্বাভাবিক। লেখক, প্রকাশক, অধ্যাপক, পুরোহিত, সেবায়েত, পূজারি, পির, খাদেম, ভিন্নমতাবলম্বী, ভিন্ন সম্প্রদায় এবং বিদেশি। মৃত্যুর মিছিলে রোজ যোগ হচ্ছে নতুন নতুন নাম।

 

এত বড় সাঁড়াশি অভিযান হলো। এত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হলো। তারপরেও রোজ একই খবর। গতকালও সাতক্ষীরায় একজন পুরোহিতকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে একই কায়দায়।

 

আর এবার খোদ গুলশানে এত এত অস্ত্র নিয়ে এত বড় সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে গুলি, বোমা, তরবারি আর রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে তারা প্রমাণ করল, আমাদের সান্ত্বনার কোনো জায়গা নেই। আমরা অনেক কিছুই পারি না, পারছি না। আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে পারছি না। আমাদের নাগরিকদের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। আমাদের বিদেশি অতিথিদের কোনো আশ্বাস দিতে পারছি না।

 

আমরা শুধু পারি কথার ঝড় তুলতে। দয়া করে, কেউ আমাকে বলতে আসবেন না, এই জঙ্গি কারা, দেশি নাকি আন্তর্জাতিক। আমার বোন সিমিন হোসেনের বিশ বছরের ভদ্র শিক্ষিত সন্তান ফারাজ তাতে ফিরে আসবে না। রবিউল করিমের অনাগত সন্তান আর কোনো দিনও বাবার মুখ দেখতে পাবে না।

 

যদি পারেন, আমাকে এই আশ্বাস দিন, আর কোনো মায়ের কোল খালি হবে না। আমাকে কেউ এসে বলুন, ভয় নেই, আমরা আমাদের উত্তর-প্রজন্মকে সুন্দর ভয়হীন আকাশের নিচে, নির্ভরতার জমিনের ওপরে রেখে যাচ্ছি।

 

অপরাধ সব দেশেই হয়, কিন্তু বলতে পারবেন কি, আর কোনো দেশে মানুষের মৃত্যু নিয়ে দলাদলি হয়! ক্ষুদ্র রাজনীতি হয়! বলতে পারবেন কি আর কোনো দেশে কত অপরাধী ধরা পড়ে না, পরিকল্পনাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়?

 

আজ আমি কলাম লিখতে আসিনি, আজ আমাকে একটু কাঁদতে দিন।