১ জুলাই ২০২০। আমাদের বাবা ট্রান্সকমের প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।
দিনটি ছিল রৌদ্রোজ্জ্বল। আমরা কুমিল্লার চিওড়ায় পারিবারিক বাসভবনে আব্বুর ঘরের পর্দা সরিয়ে দিয়েছিলাম, যাতে আলো এসে ঘর ভরে যায়। কেন জানি না, আব্বুর বিদায়ের ক্ষণে আমার মনে পড়ে যায় আরেকটি রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের কথা। আমেরিকায় আমার ছোট ছেলে ফারাজ আইয়াজ হোসেনের গাড়িতে আব্বু সেদিন রোড ট্রিপে বেরিয়েছিলেন। সামনের আসনে আব্বু আর ফারাজ। পেছনে আমি। বাজছিল আব্বুর অসম্ভব প্রিয় এলভিস প্রিসলির গান।
আজ ফারাজ নেই পাঁচ বছর। আব্বু নেই এক বছর। আমাদের জীবনে শুধুই শূন্যতা।
মনে পড়ে, আমাদের যখন শৈশব, তখন আব্বু জীবনসংগ্রামে রত। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সরকারি নীতি অনুযায়ী আমাদের পারিবারিক পাটকল ও চা-বাগানের ব্যবসা জাতীয়করণ করা হয়। আব্বুকে তাই শুরু করতে হয় শূন্য থেকে। তাঁর ওপর একান্নবর্তী পরিবারের পুরো দায়িত্ব। তিনি সকালে বেরিয়ে যেতেন, ফিরতেন রাতে। তাই শৈশবে আমরা আব্বুকে তেমন একটা পাইনি। সেই সময়টাতে দেখেছি কীভাবে মা পুরো পরিবারকে একত্র রেখেছেন, কীভাবে তাঁর সন্তান আর আব্বুর পাশে ছিলেন। আব্বুর সবচেয়ে কঠিন সময়ে, তাঁর প্রতিটি লড়াইয়ে, প্রতিটি অর্জনে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার মা ছিলেন তাঁর শক্তির উৎস। আব্বু একটা কাজ সব সময় করতেন—পরিবারকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া। বছরে অন্তত দুবার। বেড়ানোর সময়ের পুরোটা আব্বু থাকতেন আমাদের সঙ্গে। আমরা কোথায় যাব, কী কিনব, কী খাব—সব আব্বু ঠিক করতেন।
আব্বুর সঙ্গে দেশ-বিদেশের বহু জায়গা ঘুরেছি। এই বেড়াতে যাওয়া মানে শুধু গেলাম আর কেনাকাটা করলাম, তা নয়। বেড়ানো আমাদের জন্য ছিল শেখার, জানার, বোঝার—নিজেকে সমৃদ্ধ করার। আব্বু যে শহরে নিয়ে যেতেন, সেই শহরের পুরোটা ঘুরিয়ে দেখাতেন। ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে যাওয়া ছিল বাধ্যতামূলক। আর ছিল স্থানীয় খাবার খাওয়া।
নানা হওয়ার পর আব্বু নাতিদের ছুটির দিন কবে, সেটা জেনে নিতেন। এরপর বছরের শুরুতেই বেড়ানোর পরিকল্পনা ঠিক করে রাখতেন। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে ২০১৭ সালে ইতালি ও স্পেন ভ্রমণের কথা। সেবার আমরা রোম, ভিয়েনা, কর্দোবা, মাদ্রিদ, বার্সেলোনাসহ বহু শহরে গিয়েছি। বহু বছর আগে তিনি আমাদের ক্যাপ্রি দ্বীপে নিয়ে গিয়েছিলেন। এর কারণ ছিল। আব্বু যখন কলেজে পড়েন, তখন আমার দাদা ক্যাপ্রিতে গিয়ে আব্বুকে একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘ক্যাপ্রি অত্যন্ত সুন্দর একটি জায়গা। তুমি তোমার জীবনে একবার হলেও পরিবারকে নিয়ে এখানে এসো।’ আব্বু আমাদের সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন।
পড়াশোনা শেষ করে ১৯৯০ সালে আমি ট্রান্সকমে যোগ দিই। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায়। আমরা কী বিষয়ে পড়ব, কী করব—এসব নিয়ে মা-বাবা কখনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেননি। এমনকি ব্যবসায় যোগ দেওয়ারও কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। নিজের জীবনের জন্য যেকোনো লক্ষ্য বেছে নিতে আমার মা আমাকে সব সময় উৎসাহ ও সমর্থন দিয়ে গেছেন। এ ক্ষেত্রে আব্বু আমেরিকান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী জে পল গেটির ছেলে গর্ডন গেটির উদাহরণ দিতেন। বলতেন, ‘তিনি যদি নিজের অনিচ্ছায় ব্যবসায়ী হতেন, তাহলে আমরা একজন সফল ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক কম্পোজার পেতাম না।’
আব্বু বলতেন, ‘তোমরা কী করতে চাও, সেটা তোমাদের বিষয়। তবে যা-ই করবে আবেগ দিয়ে করবে। ব্যবসায় যোগ দিতে চাইলে করতে পারো। কিন্তু অনিচ্ছায় যোগ দিয়ে আমার কষ্টের প্রতিষ্ঠান নষ্ট কোরো না।’ আব্বু শুধু একটা জিনিসই জোরালোভাবে চাইতেন, আমরা যেন বিদেশে স্থায়ী না হই। তাঁর সবই ছিল বাংলাদেশে, বিদেশে কিছুই নয়।
বিদেশে পড়াশোনা শেষে আমি ট্রান্সকমে অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার পদে যোগ দিই। সেটি ছিল ট্রান্সকমের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের সর্বনিম্ন পদ।
ট্রান্সকমে যোগ দেওয়ার পর আব্বু আমাকে বলেছিলেন, ‘অফিসে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার জন্য বসে থাকবে না।’ আব্বুর অপেক্ষায় না থেকে আমি নিজের মতো করেই অফিসে চলে যেতাম।
আব্বুই আমাকে ব্যবসা শিখিয়েছেন। ব্যবসা সম্পর্ক জানার শুরুটা হয়েছিল খাবার টেবিলে। তিনি ব্যবসা নিয়ে নানা কথা বলতেন। আমরা শুনতাম। তবে আব্বু আমাকে আসলে গড়ে তুলতে শুরু করেন ১৯৯৮ থেকে, ট্রান্সকমের কার্যালয় গুলশান টাওয়ারে আসার পর।
আব্বু আমাকে বোর্ড সভায় রাখতেন। আমি দেখতাম তিনি বোর্ড সভা কীভাবে পরিচালনা করেন, কী কী বিষয়ে কথা বলেন। আমি মন দিয়ে শুনতাম, পর্যবেক্ষণ করতাম। বোঝার চেষ্টা করতাম, তিনি কীভাবে চিন্তা করেন, কীভাবে সমস্যা সমাধান করেন, কীভাবে উৎসাহ দেন। আজ আব্বু নেই। কিন্তু যখনই কোনো সংকটে পড়ি, মনে মনে ভাবি, আব্বু এ সময়ে ঠিক কী করতেন। সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিই।
আব্বু ট্রান্সকমে একটি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন—শতভাগ সততা, নৈতিকতা ও সার্বিক মান নিশ্চিত করার মূল্যবোধ। তিনি বলতেন, কর ফাঁকি দেওয়া যাবে না। পণ্যের মানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। তাতে ব্যবসা কম হোক, কিছু আসে-যায় না। আমরা সেখান থেকে একচুলও নড়িনি। আমি কোম্পানির প্রতিটি সভায় বলি, সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও শতভাগ সততাই আমাদের শক্তি। ট্রান্সকমের সবাই জানে, এসবে কোনো ছাড় নেই। এই প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যানের মূল্যবোধ সবার আগে, তারপর ব্যবসা।
আব্বু তাঁর ব্যবসায়িক জীবনে আধা ঘণ্টার জন্যও ঋণখেলাপি হননি। তাঁর অবর্তমানে গত এক বছরে আমাদের কঠিন সময় গেছে। করোনার মধ্যে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই পরিস্থিতিই ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। আমি প্রত্যয়ী ছিলাম, আমরা খেলাপি হব না। হইনি।
একটি ভালো খবরও আমি দিতে চাই। করোনার মধ্যে ২০২০ সালে ট্রান্সকমের ব্যবসা পরিস্থিতি ২০১৯ সালের প্রায় কাছাকাছি ছিল। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যবসার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এসব পরিসংখ্যান দেখলে আব্বু হয়তো খুশি হতেন।
আব্বু তাঁর প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সকমকে অন্য একটা স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা সব সময় বলতেন। সেটি কী, তা এখনই বলছি না। তবে এ কথা বলব, আমরা আব্বুর স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে চলেছি। আব্বু বলতেন, এই ব্যবসা, এই মুনাফা শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয়। এই প্রতিষ্ঠানের ওপর ২০ হাজার পরিবারের জীবিকা নির্ভরশীল, পরোক্ষভাবে প্রায় এক লাখ মানুষ। তিনি সব সময় বলতেন, এই মানুষগুলোর কথা সব সময় ভাবতে হবে।
ব্যবসার ক্ষেত্রে আব্বুর মূল্যবোধ থেকে যেমন আমরা একচুলও সরিনি, তেমনি গণমাধ্যম ব্যবসার ক্ষেত্রেও তাঁর নীতি থেকেও আমরা সামান্যতম বিচ্যুত হইনি। আমাদের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে কী লেখা হবে, কী প্রকাশিত হবে—সে বিষয়ে আব্বু কখনোই হস্তক্ষেপ করেননি। আমিও মনে করি, এটা পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের বিষয়। আব্বুকে যেটা করতে দেখিনি, সেটা আমরা কেন করব? আমরা পত্রিকার ব্যবসায়িক দিকগুলো এগিয়ে নিতে সহায়তা করার চেষ্টা করি। ব্যবসা ভালো হলে প্রতিষ্ঠানের শক্তি বাড়ে।
পারিবারিকভাবে আব্বু আমাদের সাধাসিধে জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি বলতেন, ‘ভালোভাবে থাকবে, সুন্দরভাবে থাকবে, তবে অপচয় কোরো না।’
সারাটা জীবন আব্বুকে দেখেছি কথা কম বলতে, সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে, ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে। আমাদের ছোট বোন শাজনীন রহমানকে হারানোর পর আব্বুর ভেতরে একটা অসম্ভব মানসিক শক্তি দেখেছি। সেটা ছিল তাঁর সন্তানকে ন্যায়বিচার এনে দেওয়ার জন্য। মেয়েকে হারিয়ে তিনি ভেঙে পড়েননি। দিনের পর দিন আদালতে গিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। আইনজীবীদের কাছে গিয়েছেন।
ফারাজের ঘটনার পর আব্বুর মানসিক অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি ভেঙে পড়েন। আব্বুর সঙ্গে সে সময় আমার ছেলে যারেফ আয়াত হোসেনের একটি নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যারেফ আব্বুর পাশে ছিল।
শাজনীন আর ফারাজের সঙ্গে আব্বুর একটা অন্য রকম সম্পর্ক ছিল। শাজনীনের একটি ছবি তাঁর বিছানার পাশে ও স্যুটকেসে থাকত। ফারাজের ছবি থাকত মোবাইলে। এ দুটি ছবি না দেখে তিনি ঘুমাতে যেতেন না।
আমি দেখেছি, আমাদের সঙ্গে গুরুগম্ভীর মানুষটি নাতিদের সঙ্গে ছিলেন বন্ধুর মতো। রাতে ফেরার পর আব্বু তাঁর চার নাতির সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠতেন।
আব্বু ফারাজকে নিয়ে গর্বিত ছিলেন। তাঁকে হারানোর পর তিনি সব সময় সব জায়গায় বলতেন, ‘ফারাজ আমার মতো হতে চাইত। তবে আমার মতো লোক তো অনেক আছে। কিন্তু কেউ ফারাজ হতে পারবে না। ফারাজ যা করার সাহস দেখিয়েছে, সে সাহস হয়তো আমারও হতো না।’
আমরা শাজনীনকে হারিয়েছি, ফারাজকে হারিয়েছি, আব্বুকে হারিয়েছি। জানি না আর কত পরীক্ষা দিতে হবে। আমার জীবনের এখন একটাই লক্ষ্য, আব্বুর ট্রান্সকমকে এগিয়ে নেওয়া, যেটা তাঁর সন্তানের মতো।
আমি নিশ্চিত, আব্বুর সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হবে। কোনো এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে। আবার আমরা রোড ট্রিপে বেরিয়ে পড়ব। গাড়িতে বাজতে থাকবে আব্বুর পছন্দের এলভিস প্রিসলির গান।