দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নে স্বাধীন সংবাদপত্রের ভূমিকায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং প্রয়োজন মনে করতেন লতিফুর রহমান। এ জন্যই তিনি সংবাদপত্রে বিনিয়োগ করেছেন। আগে অংশ নেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রকাশে। তারপরে প্রথম আলো। দুটি পত্রিকাতেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি তিনি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন চেয়েছেন, যে কারণে পত্রিকা বের হওয়ার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যবসা নয়; তাহলে আটকে যেতে হবে।
একটি বছর চলে গেল, আমাদের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান আমাদের সঙ্গে নেই। গত বছর এমন একটি দিনে (১ জুলাই, ২০২০) নিজ গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়ার শান্ত সবুজ পরিবেশে নীরবে-নিভৃতে সুদূরে চলে গেছেন লতিফুর রহমান, আমাদের শামীম ভাই। এর ঠিক চার বছর আগে একই দিনে নৃশংস জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। কী অবিশ্বাস্য এক মিল! আর প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে শামীম ভাই মুঠোফোনে ফারাজের ছবি দেখে ঘুমাতে যেতেন। শেষ রাতেও তিনি সেটা করতে ভোলেননি।
গত একটি বছর যে আমরা শামীম ভাইকে ছাড়া কাটিয়ে দিলাম, আসলেই কি তিনি আমাদের সঙ্গে নেই? না, প্রতিটি দিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তিনি। এখনো আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। প্রথম আলো যখন নিজস্ব নীতি ও আদর্শের পথে চলতে থাকে, যখন নিজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না, লতিফুর রহমান তখন আমাদের সঙ্গে থাকেন। যেদিন প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ দেড় কোটি লাইকের মাইলফলক অতিক্রম করল, আমরা উপলব্ধি করতে পারি, নিশ্চয়ই তিনি আনন্দের হাসি হাসছিলেন সুদূর থেকে। দৈনিক সংবাদপত্রের ফেসবুক পেজের অনুসারীসংখ্যায় প্রথম আলো বিশ্বে দশম এবং দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে আছে [সূত্র: সোশ্যাল বেকারস]। এই সংবাদ তাঁর জন্য নিশ্চয়ই সবচেয়ে বড় খুশির খবর ছিল।প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রসঙ্গে লতিফুর রহমানকে আমরা স্মরণ করি, তাঁর কথা বলি, তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি। শুধু প্রথম আলো কার্যালয় বা প্রথম আলোর কর্মীদের সঙ্গেই নয়, কোনো ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে কথা হলেও তাঁর প্রসঙ্গ চলে আসে। আমরা তাঁকে নিয়ে কথা বলি।
প্রথম আলো বা অন্য কোনো প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে শামীম ভাইয়ের কাছে আমাকে যেতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শামীম ভাই ছিলেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, কিন্তু তাঁকে আমরা সবাই পেয়েছি বন্ধুর মতো। তাঁর মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ আমরা খুব কমই দেখেছি। অমায়িক ব্যবহার ছিল তাঁর। ছোট থেকে বড় কর্মী—সবাইকে তিনি সবার আগে সালাম দিতেন, হাত বাড়িয়ে দিতেন শুভেচ্ছা জানাতে। সবার ভালো-মন্দের খোঁজ নিতেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে এই ব্যবহার বজায় রেখেছেন তিনি। একদিনের একটি ঘটনা উল্লেখ করি। দেখি, আমাদের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাঁদছিলেন। জিজ্ঞেস করতে তিনি বললেন, ‘আমি আগে স্যারকে সালাম দিতে পারলাম না।’
২.
শামীম ভাইয়ের উৎসাহে আমরা দুই মাসের প্রস্তুতিতে বের করেছিলাম প্রথম আলো। আজ প্রায় ২৩ বছর ধরে প্রথম আলো যে বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে, সে কৃতিত্বের অনেকটাই শামীম ভাইয়ের। তিনি আমাদের লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন, প্রথম আলোকে নিজের আয়ে চলতে হবে। সরকারের প্রদেয় ট্যাক্স, ভ্যাট ইত্যাদি সব কিছু মেনে চলতে হবে। দেশের সেরা পত্রিকা হতে হবে গুণমান ও সংখ্যায়। সে জন্য কাজ করার পূর্ণ স্বাধীনতা আমাদের দিয়েছিলেন তিনি।
পত্রিকার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কম নিন্দা বা হুমকি শুনতে হয়নি। বহু অপমান-অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি সব সহ্য করেছেন। বিচলিত হননি বা সামান্য নমনীয় হতে বলেননি। আমরাও অনেক কঠিন সময় পার করেছি। সেসব প্রতিকূল পরিবেশে তিনি আমাদের ছায়া দিয়ে গেছেন বড় বটগাছের মতো। সেসব মনে রেখেই আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি, চলছি।
দেশের গণতন্ত্র ও উন্নয়নে স্বাধীন সংবাদপত্রের ভূমিকায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং প্রয়োজন মনে করতেন লতিফুর রহমান। এ জন্যই তিনি সংবাদপত্রে বিনিয়োগ করেছেন। আগে অংশ নেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার প্রকাশে। তারপরে প্রথম আলো। দুটি পত্রিকাতেই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি তিনি প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন চেয়েছেন, যে কারণে পত্রিকা বের হওয়ার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সরকারের সঙ্গে কোনো ব্যবসা নয়; তাহলে আটকে যেতে হবে। সে জন্যই আজও আমরা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্র হিসেবে চলেছি।
প্রথম আলো প্রকাশের পর প্রতিটি সরকারের আমলেই নানা সমস্যা বা চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে প্রথম আলোকে কম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়নি! সরকার বা সরকার-বহির্ভূত শক্তিই শুধু নয়, কোনো কোনো প্রচারমাধ্যম ও ব্যবসায়িক মহলসহ নানা অদৃশ্য শক্তি নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবু তিনি পত্রিকার কোনো নীতিতে পরিবর্তন আনতে বলেননি কখনো। বিনিয়োগকারী হিসেবে কোনো ধরনের চাপ প্রয়োগ করেননি। কতজন কত অভিযোগ করেছেন তাঁর কাছে! তিনি বলতেন, ‘আমরা তো পত্রিকার ব্যবসায়িক দিক দেখি। নীতিনির্ধারণী দিকটি দেখেন সম্পাদক। আপনারা তাঁর কাছে যান।’ এটা বলে আমাকে জানিয়ে দিতেন শুধু কে এসেছিলেন।
পত্রিকার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে কম নিন্দা বা হুমকি শুনতে হয়নি। বহু অপমান-অপপ্রচারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি সব সহ্য করেছেন। বিচলিত হননি বা সামান্য নমনীয় হতে বলেননি। আমরাও অনেক কঠিন সময় পার করেছি। সেসব প্রতিকূল পরিবেশে তিনি আমাদের ছায়া দিয়ে গেছেন বড় বটগাছের মতো। সেসব মনে রেখেই আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি, চলছি।
৩.
এই যে প্রথম আলোকে একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া—এটা লতিফুর রহমানেরই স্বপ্নের প্রতিফলন। তাঁর কারণেই ধীরে ধীরে প্রথম আলোর জগৎ বিস্তৃত হতে থাকে। আমরা একাধিক মাসিক ম্যাগাজিন (কিশোর আলো, বিজ্ঞানচিন্তা ও চলতি ঘটনা) ও ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন (প্রতিচিন্তা) প্রকাশ করতে লাগলাম। প্রকাশনা সংস্থা প্রথমা যাত্রা শুরু করল। এর বাইরে আলোচনা, গোলটেবিল বৈঠক, গণিত অলিম্পিয়াড থেকে শুরু করে বহু কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছি। প্রথম আলো ট্রাস্ট ও বন্ধুসভারও রয়েছে বিপুল কর্মকাণ্ড। রয়েছে ডিজিটাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বহুমুখী কাজ। শুরু থেকেই
প্রতিটি বিষয়ে লতিফুর রহমান উৎসাহ জুগিয়েছেন। তাঁর সমর্থন ও সহযোগিতায়ই ডালপালা মেলে এমন বিস্তৃতভাবে ছড়িয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। প্রথম আলোর ২২ বছরে এক দিনের জন্যও তিনি আমাদের কোনো উদ্যোগে দ্বিমত পোষণ করেছেন, এমন কখনো হয়নি।
শামীম ভাইবিহীন এই এক বছরে প্রথম আলো তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল, প্রথম আলো আগের মতো থাকবে কি না। ট্রান্সকম ও মিডিয়া স্টার লিমিটেডের নতুন নেতৃত্ব আমাদের সব সময় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে আসছে এবং গত এক বছরে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে তার লক্ষ্যে অটল আছে, থাকবে। একই সময়ে প্রথম আলো তার গুণমান ও প্রচারসংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে থাকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে।
প্রথম আলো প্রকাশের পর প্রতিটি সরকারের আমলেই নানা সমস্যা বা চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে প্রথম আলোকে কম চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়নি! সরকার বা সরকার-বহির্ভূত শক্তিই শুধু নয়, কোনো কোনো প্রচারমাধ্যম ও ব্যবসায়িক মহলসহ নানা অদৃশ্য শক্তি নানাভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবু তিনি পত্রিকার কোনো নীতিতে পরিবর্তন আনতে বলেননি কখনো।
প্রথম আলোর অনলাইন এখন বাংলাদেশের ও বাংলা ভাষার ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে বিশ্বে ১ নম্বর অবস্থানে [সূত্র: অ্যালেক্সা]। পদ্মা সেতুর দুই পারের সংযোগের দিনটি ঘিরে গত বছরের ডিসেম্বরে পত্রিকা ও অনলাইনের বিশেষ বিজ্ঞাপন আয়োজন ‘প্রত্যাশার ৬.১৫ কিলোমিটার’-এর জন্য সংবাদমাধ্যমের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (INMA) আয়োজিত ‘গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ডস ২০২১’-এ একটি বিভাগে সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করে প্রথম আলো। গত ৩ জুন ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর আগে প্রথম আলো গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব নিউজ পাবলিশার্সের (WAN-IFRA) ‘সাউথ এশিয়ান ডিজিটাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড-২০২০’ লাভ করে।
৪.
এই কোভিডকাল পৃথিবীজুড়ে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সারা বিশ্বের মানুষ ভয়ের মধ্যে আছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ফলে প্রথম আলোও পারেনি এর প্রভাব এড়াতে। এই পরিস্থিতিতে নতুন এক বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়েছি আমরা। আমরা বুঝতে পেরেছি যে সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ হলো ছাপা কাগজের পাশাপাশি ডিজিটাল মাধ্যম। তাই আমাদের অনলাইন বা ডিজিটাল মাধ্যমকে আমরা আরও শক্তিশালী ও বৈচিত্র্যময় করছি। এসবের ফলে আমাদের কাজের চাপ ও পরিধি আরও বেড়েছে। এই ভয়ের পরিস্থিতিতে প্রথম আলোর প্রত্যেক কর্মী ও তাঁদের পরিবার আমাদের সমর্থন দিচ্ছেন। সাহস দিচ্ছেন, পাশে দাঁড়িয়েছেন। কখনো পুরো টিমের হোম অফিস, কখনো অর্ধেক হোম অফিস—নানাভাবে আমরা চলছি। আমাদের লক্ষ্য, প্রথম আলো টিকে থাকবে দীর্ঘ-সুদীর্ঘকাল। আমরা আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখব। তবেই টিকে থাকবে লতিফুর রহমানের স্বপ্ন ও আদর্শ। তাঁকে আজ বিশেষভাবে স্মরণ করছি এবং তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি।
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো