লতিফুর রহমান কখনো স্থায়ী সম্পদ গড়তে চাননি, চেয়েছেন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে। আর সেই প্রতিষ্ঠান গড়ার কাজটি করেছেন সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে। অর্থ নয়, তিনি বেশি চেয়েছেন সুনাম। তাই নীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে আপস করেননি কখনো। এসব ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে উজ্জ্বল একটি নাম লতিফুর রহমান। আর এভাবেই দেশের একজন অনন্য শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে যেমন প্রায় শূন্য হাতে শুরু করতে হয়েছিল, লতিফুর রহমানের শুরুটাও ছিল ঠিক তেমনই। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার একজন সহযাত্রী হিসেবেই তাঁর পরিচয়। লতিফুর রহমান প্রতিষ্ঠান গড়েছেন, কর্মসংস্থান তৈরি করেছেন, সরকারকে কর দিয়েছেন, বিদেশ থেকে সুনামও এনেছেন। অনেক কিছু না পাওয়ার এই দেশে লতিফুর রহমান ব্যবসায়ী সমাজে একটি উদাহরণ। নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও পরিশ্রমই লতিফুর রহমানকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে। নিজের মূল্যবোধের আলোকে দৈনন্দিন জীবন যাপন করতেন লতিফুর রহমান। এই মূল্যবোধের প্রভাব ছিল তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কৃতি ও চর্চায়।
চা ও পাট ব্যবসা দিয়ে জীবন শুরু করেছেন, কিন্তু চলে গেছেন তা ছাপিয়ে। নিজের উদ্যোক্তা–সত্তাকে নানা দিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যবসা ও প্রতিষ্ঠানকে করেছেন বহুমুখী। একজন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও আধুনিক উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রধান দুটি গণমাধ্যমের মালিক হয়েছেন, কিন্তু তাঁর অন্য ব্যবসায়িক উদ্যোগে এর অপব্যবহার করেননি।
আক্ষরিক অর্থেই তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিলেন। তাঁর দাদা খান বাহাদুর ওয়ালিউর রহমানের জন্ম চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামেই। তবে বড় হয়েছেন আসামের জলপাইগুড়িতে, মামার বাড়িতে। সেখান থেকে আইন পাস করে জলপাইগুড়ি বারে আইনি পেশা শুরু করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে সেখানে কিছু জমি কিনে চা-বাগান শুরু করেন। তখন চা-বাগানের মালিক ছিল মূলত ব্রিটিশরা। দাদার চা-বাগানই ছিল দেশি মালিকানায় কারও প্রথম বাগান। লতিফুর রহমানের বাবা মুজিবুর রহমানের জন্মও সেখানে। তিনিও খান বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। দেশভাগের পর ঢাকায় ফিরে পাটের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সিলেটে নতুন করে চা-বাগানও করেন।
লতিফুর রহমানের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট, জলপাইগুড়িতে। দেশ বিভাগের পর ঢাকায় ফিরে গেন্ডারিয়ায় থাকতেন। সেখানেই পড়াশোনার শুরু। ১৯৫৬ সালে ভর্তি হন শিলংয়ে সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে। সেখান থেকে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধপরবর্তী হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে ঢাকায় ফিরে ঢুকে যান পাট ব্যবসায়। চাঁদপুরে বাবার তৈরি ডব্লিউ রহমান জুট মিলে একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এরপরেই আসে ১৯৭১। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পারিবারিক পাটকলটি জাতীয়করণ করা হয়। চা-বাগান থাকলেও বন্ধ হয়ে যায় রপ্তানি। নগদ টাকার প্রবল সংকটে পড়েন তিনি। ৫২ মতিঝিল ঠিকানায় কেবল একটি অফিস ছিল তাঁর। ভাড়া করে আসবাব এনে, ঘরের পাখা খুলে অফিসে লাগিয়ে আবার নতুন করে শুরু করতে হয় লতিফুর রহমানকে। ১৯৭৪ সালে উত্তরা ব্যাংক থেকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুন উদ্যমে সেই যে শুরু করেছিলেন, তারই পুরস্কার ট্রান্সকম গ্রুপ। লতিফুর রহমানের হাত ধরেই ট্রান্সকম গ্রুপ আজ দেশের অন্যতম বড় শিল্প পরিবার। ১৮৮৫ সালে চা–বাগানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এই গ্রুপের পথচলা। এখন ওষুধ, খাদ্য ও পানীয়, ইলেকট্রনিকস, মিডিয়াসহ নানা ধরনের ব্যবসায় সমৃদ্ধ এই গ্রুপ।
লতিফুর রহমান ব্যবসায়ী সমাজের নেতৃত্বও দিয়েছেন সফলতার সঙ্গে। তিন দফায় সাত বছর তিনি ছিলেন দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের (এমসিসিআই) সভাপতি। ছিলেন বৈশ্বিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সহসভাপতি। আবার ২০১৪ সালে এর মূল সংগঠন প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন তিন বছরের জন্য। এ ছাড়া তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) পরামর্শক কমিটির সদস্য ছিলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি হিসেবে লতিফুর রহমান ২০১২ সালে পান ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’। সেটাই ছিল বাংলাদেশে কোনো উদ্যোক্তার পাওয়া এ ধরনের প্রথম পুরস্কার। আবার ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও নীতিগত মূল্যবোধের আদর্শের মেলবন্ধন ঘটানোর বিরল নজির সৃষ্টি করার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে ভারতের মুম্বাইয়ে ২০১৭ সালে লতিফুর রহমানকে দেওয়া হয় ‘সার্ক আউটস্ট্যান্ডিং লিডার’-এর সম্মাননা। ওই অনুষ্ঠানে পেপসিকোর ইন্ডিয়া রিজিয়নের চেয়ারম্যান শিবকুমার লতিফুর রহমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এভাবে, ‘ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সৎ, নিষ্ঠাবান ও দয়ালু থেকে কীভাবে এক বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, লতিফুর রহমান তার নিদর্শন।’ একই বছর বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে অবদান রাখা এবং নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করায় লন্ডনে লতিফুর রহমানকে আজীবন সম্মাননা দেয় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশিদের শীর্ষ ব্যবসায়িক সংগঠন ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্ট অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ইউকেবিসিসিআই)। তাঁর নেতৃত্বেই ট্রান্সকম বেভারেজেস ২০০৯ ও ২০১৬ সালে গ্লোবাল বটলার অব ইয়ার নির্বাচিত হয়েছিল।
নানা ধরনের চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে লতিফুর রহমানকে। এসেছে নানা বাধা ও বিপত্তি। উপর্যুপরি পারিবারিক ট্র্যাজেডি থমকে দিয়েছে। কনিষ্ঠ কন্যা ও প্রিয় নাতির মৃত্যুর শোক বহন করেছেন। কিন্তু নিজের কাজ থেকে দূরে থাকেননি। বরং নতুন নতুন উদ্যোগের সঙ্গে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। আবার সততা ও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা কখনো ভোলেননি লতিফুর রহমান। প্রতিবছর নিয়মিত কর দিয়েছেন। ২০১৬-১৭ করবর্ষে সরকার একবারই নিয়মিত কর দেওয়া পরিবারকে ‘কর বাহাদুর পরিবার’ উপাধি দিয়েছে। লতিফুর রহমান পরিবার পান সেই উপাধি। ট্রান্সকম গ্রুপের একাধিক প্রতিষ্ঠান এখনো প্রতিবছর সেরা করদাতার পুরস্কার পেয়ে আসছে।
লতিফুর রহমান কখনোই স্থায়ী সম্পদ তৈরি করার জন্য বড় বিনিয়োগে উৎসাহ বোধ করেননি। বহুতল ভবন বানিয়ে ভাড়া দিয়ে জীবন চালানোর কথা ভাবেননি। কেবল বাণিজ্যের মধ্যেও আটকে থাকেননি। বরং এমন প্রতিষ্ঠান গড়তে চেয়েছেন, যা শতাব্দী পেরিয়েও টিকে থাকতে পারে। এ জন্য তিনি আধুনিক ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা রাখতেন। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার নীতি হচ্ছে, সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক জায়গায় নিয়ে এসে তাঁকেই পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে। তাঁকে সম্মান দিতে হবে। আমার প্রতিষ্ঠান সেভাবেই চলে। এভাবে না চললে তো সব প্রতিষ্ঠান পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হয়ে থাকবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, ব্যবস্থাপনার মানও হতে হবে বিশ্বমানের। আমি সেভাবেই চেষ্টা করছি।’
পারিবারিক মূল্যবোধকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন লতিফুর রহমান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বক্তৃতায়, সাক্ষাৎকারে একাধিকবার বলেছেন, ‘আমাদের পরিবারের সবার একটাই পাসপোর্ট—বাংলাদেশের। আমরা কখনো অন্য দেশের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করিনি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, এ দেশের প্রতি আমার আস্থা আছে।’ তরুণদের প্রতিও গভীর আস্থা ছিল লতিফুর রহমানের। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের তরুণ প্রজন্মই বাংলাদেশকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
লতিফুর রহমান চলে গেছেন। তাঁর এই চিরপ্রস্থান সবার জন্যই অপূরণীয় ক্ষতি। তবে সততা ও সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে ব্যবসায়ী সমাজের প্রতি সাধারণ মানুষের অনেক ধারণা যেমন বদলে দিয়েছেন তিনি; তেমনি দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে পরিচালনা করতে হয়, রেখে গেছেন তারও উদাহরণ। নতুন ব্যবসায়ী প্রজন্মের মধ্যে সেই চেতনার উন্মেষই ছিল তাঁর স্বপ্ন।