লতিফুর রহমান শামীম আমার কাছে দূর আকাশের নক্ষত্রই। কেবল প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাদিনের অনুষ্ঠানে একটু আগে গেলে বা শেষ পর্যন্ত থাকলে তাঁর সেই কিংবদন্তিসম বিনয়ের ছোঁয়া মিলত বয়স ও সামাজিক ব্যবধান সত্ত্বেও।
তো সেই নক্ষত্র যখন সাতসকালে টেলিফোনে আলো ছড়ান, বলেন, ‘বুলবুল, আমি শামীম বলছি, লতিফুর রহমান। প্রথম আলোর। মতি ভাইয়ের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে ফোন করছি।’
মতি ভাই, প্রথম আলো, মিলাতে পারি কিন্তু লতিফুর রহমান শামীম? কোনো সমীকরণেই মেলে না। তিনি কেন ফোন করবেন, এই সাতসকালে? একটু ঘাবড়ে যাই। কিছুটা ধন্দেও পড়ি!
আগের রাতে বাংলা ভিশনে টক শোতে ছিলাম। মধ্যরাতে সংবাদপত্র ধরে আলোচনা। সেদিনের শিরোনাম: বসুন্ধরা শপিং মলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে। সেই মামলার আসামি করা হয়েছে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে। এই খবর কোনো কোনো পত্রিকায় বড় করে ছাপাও হয়েছে। খবরটি আমাকে উত্তেজিত করে প্রবলভাবে। এ বিষয়ে উপস্থাপক আমার মন্তব্য জানতে চাইলে কিছুটা উচ্চকণ্ঠেই কথা বলেছিলাম। শেষ মন্তব্যটি ছিল: আগামীকাল সারা পৃথিবীর সামনে যদি বলা হয়, পৃথিবীতে আজ সবচেয়ে বড় মিথ্যা খবর কোনটি? গোটা পৃথিবী বলবে, শপিং মলে আগুনের ঘটনায় মতিউর রহমান ও গোলাম সারওয়ারের জড়িত থাকার খবরটি। এর চেয়ে বড় মিথ্যা আজকের দিনে পৃথিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। এই মামলা কেউ বিশ্বাস করবে না। মামলা যাঁরা করেছেন, তাঁদেরও কেউ বিশ্বাস করবে না।
ঘটনার সঙ্গে দুই প্রিয় মানুষের নাম জড়িত থাকার কারণেই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন ছিল।
অনুষ্ঠানের পরপর রাতেই প্রথম আলোর বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলাম। কিন্তু অত রাতে জনাব লতিফুর রহমান এই অনুষ্ঠান দেখছেন, এমনটি ধারণাই করতে পারিনি।
সাতসকালে সেই ফোনে তিনি বলছিলেন, ‘আপনি যেভাবে “গাটস” নিয়ে প্রতিবাদটি করলেন, সে জন্য ধন্যবাদ জানাতেই ফোন করছি। প্রতিবাদ করা এক বিষয় কিন্তু সাহস নিয়ে, দায়িত্ব নিয়ে প্রতিবাদ করা অন্য বিষয়।’
শিখলাম: শুধু প্রতিবাদ করা নয়; প্রতিবাদ করতে হবে সাহস নিয়েই, দায়িত্ব নিয়ে।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি শেখার তা হচ্ছে, কাউকে ধন্যবাদ জানানোর সৌজন্যটুকু বয়সের দেয়াল দিয়ে বাঁধা নয়। একজন প্রবীণও নবীনকে সম্মান জানাতে পারেন। একটি ভালো সংস্কৃতির সমাজের এটিও একটি সূচক। কিন্তু ক্ষমতা, অর্থ বা বয়সের বড়ত্ব আমাদের সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই সব বড়ত্বের মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায়। লতিফুর রহমান তা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন।
সেই ঘটনার পর থেকে জনাব লতিফুর রহমানকে শামীম ভাই বলার সাহস ও অধিকার পাই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম মতি ভাইই।
শামীম ভাইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় সংলাপ আমার একটি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে। মতি ভাইই সময় নির্ধারণ করে দিলেন তাঁর গুলশান অফিসে। যথারীতি সেই বিনয় দিয়ে শুরু, আমি কুণ্ঠিত। আমার জন্য বরাদ্দ সময় পুরোটাই তাঁর নানান আলোচনায় পূর্ণ। নিজের একটি টেলিভিশন হতে গিয়েও কেন হলো না, কীভাবে হলো না, সেই গল্প বললেন। তবে আশাবাদী ছিলেন, তাঁর মিডিয়া হাউসে একটি টেলিভিশন যুক্ত হবে একদিন। আমি হেসে বললাম, আপনার টেলিভিশন হলে তাতে যোগ দেব। স্মিত হেসে বললেন, ‘মতি ভাই তো প্রথম আলো নিয়ে দুবার কথা বললেন, কিন্তু আপনার সঙ্গে ব্যাটে-বলে হলো না।’ সেদিনই কথায় কথায় তাঁর ব্যবসা শুরু এবং প্রথম ব্যাংক সহায়তা পাওয়ার কথা বললেন। আমিও সুযোগ পেয়ে বললাম, শামীম ভাই, ওই ব্যাংকার তো আপনার বাবাকে চিনতেন, তাই আপনাকে মার্জিন ছাড়াই ঋণ দিয়েছেন, সবার তো আর তেমন সুযোগ হবে না। তিনি বললেন, ‘দেখেন প্রকৃত ব্যাংকাররা কিন্তু প্রকৃত ব্যবসায়ীকে তাঁর প্রস্তাব দেখেই চিনতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা সহযোগিতা করার ঝুঁকিও নিতে চান। কিন্তু এখন তো ব্যবসার প্রস্তাব যেমন, ব্যাংকের হালও তেমন।’ এইটুকুতেই দেশে ব্যাংকিং অবস্থার চিত্র বুঝিয়ে দিলেন। বুঝি, রুচিবিরুদ্ধ বলেই কারও নাম নিলেন না, কারও বিরুদ্ধেও কিছু তুললেন না।
শেষে যখন আমার সমস্যাটির কথা বললাম, তখন বললেন তাঁর ব্যবস্থাপনা দর্শনের কথা। তিনি বললেন, ‘আমি আমার কোনো ইউনিটেই হস্তক্ষেপ করি না। কোনো সমস্যা হলে আলোচনা করি, আমার কোনো পরিকল্পনা থাকলে জানাই।’ বললেন, ‘আপনার কাজটাও ওই পদ্ধতির মধ্য দিয়েই যাবে। শেষ পর্যন্ত কাজটা হয়েছিল। সে জন্য আজও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
বাংলাদেশে সংবাদপত্র ব্যবস্থাপনা, মালিকানা এসব নিয়ে সারওয়ার ভাই—গোলাম সারওয়ার আর আমি মাঝেমধ্যেই দীর্ঘ সময় আলোচনা করতাম। প্রসঙ্গক্রমে বারবার লতিফুর রহমানের নাম আসত। আমাদের সংবাদপত্রের বহু মালিক নিজের পত্রিকাটি প্রথম আলোর মতো হোক, সেটা চান কিন্তু নিজেরা লতিফুর রহমান হতে চান না। লতিফুর রহমান যেমনটি করতেন: যোগ্য লোকটিকে বাছাই করে তাঁর হাতে সবটুকু দায়িত্ব তুলে দেওয়া। এমনটি করেন, এমন মালিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। বরং অনেক মালিক অযোগ্যজনকেই খোঁজেন, যাতে অযোগ্য লোকটি নিজের অযোগ্যতা ঢাকতেই দমে দমে মালিকের সন্তুষ্টিতেই জীবনটাকে উৎসর্গ করেন। তাতে দুজনেরই লাভ। একজনের চাকরি রক্ষা হয়, আরেকজনের সর্বব্যাপী স্বার্থ রক্ষা হয়। প্রতিষ্ঠান বা সাংবাদিকতার বাজে বারোটা। আমাদের দেশে বিরল ব্যতিক্রমদের একজন লতিফুর রহমান। চাকরি করতে গেলে চাকরিপ্রার্থীর যোগ্যতা থাকা যেমন দরকার, বিনয়ের সঙ্গে বলি, তেমনি মালিক হওয়ারও যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। শুধু অর্থ বিনিয়োগ করার ক্ষমতাই একমাত্র যোগ্যতা নয়।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের মালিকানার যোগ্যতায় লতিফুর রহমান হতে পারেন মাপকাঠি। এই অর্জনটি কম বড় বিষয় নয়। ধারণা করি, অর্জনটি তিনি করতে পেরেছিলেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই। তিনি শিখরে উঠেছিলেন তাঁর নিজের যোগ্যতাবলেই। কোনো কিছু মুফতে পাওয়ার পথে চলেননি। আমাদের দেশে এখন মিডিয়াসহ সব ব্যবসাতেই মুফতে পাওয়াদের ভিড় বেশি। এই লোভকে অতিক্রম করাও কঠিন ব্যাপার। লতিফুর রহমান সেই লোভ এড়িয়ে চলার সাহস ও যোগ্যতা দুটোই রাখতেন।
তাঁর আরেক অর্জন, দুর্নীতির কারণে বারবার সুনাম হারানো বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। শামীম ভাইয়ের নামটি ‘বিজনেস ফর পিস’ পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করে বাংলাদেশের ইন্টারন্যাশনাল চেম্বারের প্রাণপুরুষ, আরেক সজ্জন ব্যবসায়ী মাহবুবুর রহমান বলছিলেন, ‘সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম—তিনটিতেই লতিফুর রহমান বিশাল উচ্চতায়। লতিফুর রহমানের বিজয় তো সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে।’
শামীম ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা ফারাজের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর বাসায় মিলাদ মাহফিলে। অনুষ্ঠান শেষে আগত সবাইকে এক এক করে হাত মিলিয়ে বিদায় জানাচ্ছেন তিনি, এমনকি আমাকেও।
অনেক ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম তিনি। তিনি আকাশছোঁয়া অট্টালিকা গড়েননি; বিদেশে বাড়ি করা তো দূরে, পাসপোর্টও নেননি। তাঁর অফিসের সাজসজ্জার রুচিতেই শুধু নয়, অফিস বা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনাতেও তিনি ব্যতিক্রম। এতসব ব্যতিক্রম, তাঁর সেই বিনয়, ছোট-বড় সবাইকে সম্মান জানানো, আর ভালো কিছু করলে উৎসাহ দেওয়ার, সাহস দেওয়ার দৃষ্টান্তই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে।
এ ধরনের বটবৃক্ষের ছায়া সরে যাওয়া আমাদের নিঃস্ব করে।