শামীম, মানে লতিফুর রহমান আমার বাবার এক বোনের বড় ছেলে। আমার বাবা-চাচাদের আপন কোনো বোন ছিল না। কাজেই শামীমের মা, আমাদের সাকেরা ফুফিই বাবার আপন বোনের মতো ছিলেন। খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন বাবা-চাচাদের। শামীম আর তার ভাইবোনেরা ছিল তাঁর নিজের সন্তানের মতো। আমার বাবা ছিলেন পরিবারের নেতা। শুধু নিজের ভাইবোনদের মধ্যেই নন, বরং সব চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনও তাঁর কথা মেনে চলত। শামীমের মা-বাবা, আমার ফুফি–ফুফা পারিবারিক বা ব্যবসায়িক প্রায় সব বিষয়েই বাবার পরামর্শ নিতেন।
শামীম আর আমি এমন এক সময়ে বড় হয়েছি, যখন পারিবারিক বন্ধন ছিল নিবিড়। নিজের আর চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনদের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল না সে সময়। আমরা সবাই ছিলাম বড় একটি পরিবারের অংশ। এমনকি একই শহরে আলাদা বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও আমরা এক ছিলাম। সুখে-দুঃখে, একসঙ্গে খাবার খেতে, পরামর্শ করতে যখন-তখন পারিবারিক সম্মিলন হতো। এই ঐতিহ্যই আমাদের একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে। আমরা একে অপরের সঙ্গে সমহারে সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছি।
শামীমের জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট। সে আমার চেয়ে তিন বছরের ছোট, আর আমার ছোট ভাই তৌকিরের চেয়ে পাঁচ মাসের বড়। তৌকিরের সঙ্গেই হোলি ক্রস স্কুলে পড়ত সে। এরপর তারা চলে যায় শিলংয়ে বোর্ডিং স্কুলে। সেখানে তার সঙ্গে দেখা হয় তার ছোটবেলার প্রেম জয়ুর সঙ্গে। সেও শিলংয়ে পড়ত। ১৯৬৪ সালে খুব অল্প বয়সেই বিয়ে করে শামীম। এ কারণে মা-বাবার তরফ থেকে তাকে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছিল। তবে আমার বাবা শামীমের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করার পর সেসব শর্ত যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। শামীমকে মেনে নেওয়া হলো। বাবা শামীমের স্ত্রীকে ব্যক্তিগতভাবে পরিবারে স্বাগত জানালেন।
শামীমের সঙ্গে আমার স্মৃতি সেই শৈশব থেকে। আমাদের একসঙ্গে কাটানো সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা আজও মনে পড়ে। আমার মনে পড়ে, লায়ন সিনেমা হলে আমরা একসঙ্গে ‘টারজান’ সিনেমা দেখতে যেতাম। আমার ফুফা আমাদের যেতে দিতেন। শামীমের ছোট মামা—যিনি আমার চেয়ে ১০ বছরের বড় এক চাচা—আমাদের সঙ্গে থাকতেন বলে নয়, শামীম যেত তার তারিক ভাইয়ার সঙ্গে।
আমার ভাই তৌকির প্রায়ই বলে যে শামীমের সঙ্গে তার শৈশবের স্মৃতিগুলো খুব সুন্দর। তারা মার্বেল খেলত, একে অপরের সঙ্গে লড়াই করত। তৌকিরের ঘাড় চেপে ধরত সে, একে অপরের সঙ্গে মারপিট করত, মাটিতে গড়াগড়ি করে জামাকাপড় নোংরা করে ফেলত। সেই দিনগুলো ছিল আনন্দের।
শিলংয়ে পড়ালেখা শেষে শামীমের বাবা চাইলেন, সে যেন ইংল্যান্ডে পড়তে যায়। কিন্তু শামীম যেতে চায়নি। আমার মনে পড়ে, এক সন্ধ্যায় শাকেরা ফুফি, ফুফা আর শামীম এল আমাদের বাড়িতে। বাসায় ঢুকেই তারা তিনজন চলে গেল মা-বাবার ঘরে। এরপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। ফুফা-ফুফি আব্বাকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন শামীমকে ইংল্যান্ডে যেতে এবং পড়ালেখা শেষ করার বিষয়টি বোঝান। কিন্তু শামীম কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। শামীম কী করতে চায়, আব্বা সব শুনলেন। এরপর তিনি ফুফা-ফুফিকে বললেন, তার ওপর যেন জোর খাটানো না হয়। তাকে যেন নিজের ব্যবসা শুরু করতে দেওয়া হয়। তিনি সে সময়ই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, সে সফল হবে। এরপর সে চাইলে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করতে পারে। ফুফা কিছুটা হতাশ হলেন ঠিকই, তবে মেনে নিলেন।
এরপর শামীমের এগিয়ে চলার দিকে তাকালে দেখা যাবে, সে ক্রমেই বড় হয়েছে এবং পারিবারিক ব্যবসায় বৈচিত্র্য এনেছে।
আমার মতো সেও সংগীত পছন্দ করত। ভালোবাসত সাম্বা শুনতে। আমার স্ত্রী নাজমা বলে যে শামীম নাকি ভালো নাচতেও পারত। ১৯৭৬ সালে আমি যখন জার্মানির বনে কর্মরত, সে সময় শামীম আর জয়ু আমাদের ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল। আমার স্ত্রী আজও স্মরণ করে, সে সময় জয়ু তাকে আর শামীমকে একসঙ্গে নাচতে পীড়াপীড়ি শুরু করেছিল। আমার বোন শামীমকে মনে রেখেছে অত্যন্ত দয়ালু, যত্নশীল, স্নেহশীল ভাই হিসেবে। ১৯৯৬ সালে তার স্বামী যখন মারা যায়, আমরা ভাইয়েরা সব দেশের বাইরে ছিলাম। সে সময় শামীম তার পাশে দাঁড়িয়েছে, সবকিছু সামলাতে সহযোগিতা করেছে।
ঢাকায় আমাদের প্রথম দিককার সময়গুলো ছিল সুখের। তবে আমিও বাড়ি আর দেশ থেকে দূরে চলে গেলাম। ভিনদেশে যেন যাযাবর জীবন যাপন করতে লাগলাম। নিজেদের মধ্যকার এবং পারিবারিক যোগাযোগ কখনোই বিচ্ছিন্ন হয়নি আমাদের। তবে কিছুটা কমে এসেছিল। অল্প সময়ের জন্য দেশে এলেও আমরা সাক্ষাৎ করতাম।
শামীম তার মা-বাবার এবং পরিবারের প্রত্যাশা পূরণ তো করেছেই; তবে আরও বেশি কিছু করেছে। সে উদ্যোক্তাদের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্যোতিষ্কে পরিণত হয়েছে, দূরদর্শিতা দিয়ে পথ দেখিয়েছে। ভাই হিসেবে তাকে নিয়ে আমার গর্ব হয়।
তবে শামীমের জীবনেও বেদনা ছিল। কোনো মানুষের জীবনে যতটুকু বেদনা থাকার কথা, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি। তবে এসব হারানোর বেদনায় সে কখনোই হতাশ হয়নি কিংবা হতোদ্যম হয়ে পড়েনি। আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস ছিল অগাধ। সর্বশক্তিমানের করুণায় ছিল তার অটল বিশ্বাস। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং পরিবারের প্রতি তার অনুরাগ দিন দিন বহুগুণে বেড়েছে।
শামীমের মৃত্যু আল্লাহরই ইচ্ছা। আসলে আমারই আগে যাওয়ার কথা ছিল। তার মৃত্যুতে আমার মনে প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে। তবে এও স্মরণ করি যে সৃষ্টিকর্তা নানাভাবে দয়াশীলদের পরীক্ষা করেন এবং কখনোই সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস হারাতে নেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমাদের মরণশীল দেহ অবশ্যই মাটিতেই ফিরে যাবে। আত্মা সৃষ্টিকর্তার কাছেই ফিরে যায়, পৃথিবীতে অন্যদের জন্য রেখে যায় ভালো, হিতৈষী আর অনুপ্রেরণাদায়ী কাজ। ভাইয়ের জন্য আমার মন পুড়বে। তার মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। তবে তার জীবনের অর্জনের জন্য আমি সব সময়ই গর্ব করব।
তারিক করিম: সাবেক রাষ্ট্রদূত
লতিফুর রহমান স্মরণে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘স্মৃতি ও কৃতি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সভায় দেওয়া বক্তব্যের অনুবাদ