লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল ব্যবসায়িক সূত্রে। আমি বিজ্ঞাপন সংস্থা এশিয়াটিকের সঙ্গে জড়িত। এশিয়াটিকের পক্ষ থেকে আমিই প্রথম তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশে পেপসির ব্যবসা ট্রান্সকম গ্রুপের কাছে গেল। সে সূত্রে তিনি আমাদের ডেকে পাঠালেন। কারণ, আগে যাঁরা পেপসির প্রতিনিধি ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমরা কাজ করতাম। এ ব্র্যান্ড দেখাশোনা করতাম বলে আমি নিজে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তখন তাঁকে দেখেছিলাম শুধু একজন ব্যবসায়ী হিসেবেই। তাঁর সঙ্গে পেশাদারি কথাবার্তাই হয়েছিল। কীভাবে একটি পণ্যের আরও প্রচার করা যায়, সবার আরও কাছে নিয়ে যাওয়া যায়, কীভাবে বাজার প্রসার করা যায়, এ ধরনের কথাবার্তা হয়েছিল।
বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর হঠাৎ লক্ষ করলাম, আমি তাঁকে ‘শামীম ভাই’ ডাকতে শুরু করেছি। আর তিনিও আমাকে নাম ধরে ডাকতে শুরু করছেন। তিনি সহজেই কাউকে ‘তুমি’ বলতেন না, কিন্তু আমকে তিনি তুমি বলতে শুরু করছেন। যাঁরা তাঁকে হয়তো প্রথম বা একটু দূর থেকে দেখেছেন, তাঁদের মনে হতো যে তিনি একটা শক্ত আবরণের ভেতরে আছেন। কিন্তু আমার সঙ্গে তিনি সেই আবরণ ভেঙে ফেলেছিলেন। তিনি আমার নাটকের খোঁজ নিতেন। মহিলা সমিতিতে সপরিবারে দু-একবার নাটক দেখতেও এসেছিলেন। এভাবে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটা আর ব্যবসার মধ্যে সীমিত থাকেনি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের দিকে গড়িয়ে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সম্পর্কটি সুদৃঢ় হয়ে ওঠে। আমি নানাভাবে তাঁর স্নেহ অনুভব করতে শুরু করি। এর বিশদ বিবরণ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রসঙ্গটি অবশ্য বলতেই হয়। ১৯৯৩ সালে সেগুনবাগিচায় আমরা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ শুরু হলো। এ সূত্রে শামীম ভাইয়ের নামটা আমাদের মনে এল। আক্কু চৌধুরী প্রাথমিকভাবে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। আক্কু চৌধুরীর সঙ্গে শামীম ভাইয়ের খুবই হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। তাঁকে তিনি খুব স্নেহও করতেন। আমি আর আক্কু প্রথমেই গেলাম তাঁর কাছে।
এর আগে শামীম ভাই কখনোই আমাদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। রাজনীতি থেকে সব সময় কিছুটা দূরেই থাকতেন। ওই দিন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রসঙ্গে তিনি দুটো কথা আমাদের বললেন। বললেন, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর বললেন যে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, সে সময়ে নিরীহ মানুষদের হত্যা ও ধর্ষণ করেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি হওয়া জরুরি। এটা না হলে জাতির কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। যে মানুষটি কোনো দিনই রাজনীতি নিয়ে একটি শব্দও কখনো আমাদের সামনে উচ্চারণ করেননি, উপলব্ধি করলাম, সেই মানুষের চিন্তার গভীরে এই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় প্রবলভাবে উপস্থিত। আমি চমৎকৃত হয়ে গেলাম। তিনি আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। একবার নয়, একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরকে তিনি সহায়তা করেছেন। প্রথমবার যখন আমরা শুরু করি তখন। পরে যখন আমরা নতুন ভবনের কাজ শুরু করলাম, তখনো তিনি উদার হাতে সহযোগিতা করেছিলেন।
শামীম ভাইয়ের সঙ্গে পরে পারিবারিকভাবেও যোগাযোগ হয়েছে। তাঁর বাড়িতে আমার যাওয়ার এবং এক টেবিলে বসে খাওয়ারও সুযোগ হয়েছে। সেখানে তিনি ছিলেন অসাধারণ অতিথিপরায়ণ। প্রত্যেকের প্লেটের দিকে তাঁর নজর থাকত। কার প্লেটে কী নেই, কোনটা একটু ভালো লেগেছে, এটা তুলে দাও, এটা খেতে ভালো হয়েছে—সবদিকে তাঁর লক্ষ থাকত।
শাজনীনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি তো সবারই জানা। আমার মনে আছে, সেই দুর্ঘটনা ঘটার পর আমি নিজের বেদনা থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম। মতিউর রহমান তখন ভোরের কাগজের সম্পাদক। লেখাটা আমি সেখানে ছাপতে দিই। লেখাটা শামীম ভাই পড়েছিলেন। কয়েক দিন পরে শামীম ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা। তিনি আমার হাতটি গভীর মমতার সঙ্গে ধরে বললেন, তোমার লেখাটি আমি পড়েছি। ব্যস, ওইটুকুই, আর কিছুই বলেননি। কিন্তু ওই যে হাতটা ধরলেন, তার মধ্য দিয়ে আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, তাঁর মনের ভেতরে প্রচণ্ড ঝড় বইছে। সে ঝড় আমাকেও আক্রান্ত করল। আমি সেদিন আবেগ ধরে রাখতে পারিনি।
শামীম ভাই একজন সৎ মানুষ ছিলেন। নৈতিকভাবে ব্যবসা করেছেন। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ কথাগুলো সবাই বারবার আলোচনা করছেন। কিন্তু মেয়ে শাজনীন আর নাতি ফারাজকে হারানোর পর একজন মানবিক মানুষ, স্নেহময় পিতা, মমতাময় নানা হিসেবে তিনি পৃথিবীর মতো সর্বংসহা হয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, এত বেদনার পাহাড় বহন করেও তিনি তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেছেন প্রতিটি মুহূর্তে।
দেশটাকে যে শামীম ভাই ভালোবাসতেন, হয়তো সেই ভালোবাসা থেকেই জীবনের শেষ সময়গুলো কাটিয়েছেন গ্রামবাংলায়। সেই গ্রামবাংলা থেকেই তিনি বিদায় নিলেন আমাদের মধ্য থেকে। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের জন্ম হয়, কিন্তু কোটি কোটি মানুষ মনে থেকে যান না। শামীম ভাই আমাদের হৃদয়ে জীবিত থাকবেন, যত দিন আমরা জীবিত থাকব।
আসাদুজ্জামান নূর: অভিনয়শিল্পী
লতিফুর রহমান স্মরণে ২০২০ সালের ১৪ জুলাই প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘স্মৃতি ও কৃতি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সভায় দেওয়া বক্তব্যের অনুবাদ
আসাদুজ্জামান নূর