আমাদের প্রিয় লতিফুর রহমান আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এমন একটি দিনে তিনি চলে গেলেন, যেদিন চলে গিয়েছিল তাঁর প্রিয় নাতি ফারাজও। চার বছর আগে এই একই দিনে নৃশংস জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান ফারাজ আইয়াজ হোসেন। এভাবে একই দিনে নাতির পর নানার বিদায় আমাদের জন্য মেনে নেওয়া খুবই বেদনার, খুবই কঠিন।
লতিফুর রহমান, আমাদের শামীম ভাই বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। শত ব্যস্ততা থেকে একরকম গুটিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়ায় নিজের তৈরি আবাসে গাছপালা, পুকুর ও শান্ত সবুজে ঘেরা পরিবেশে নিভৃতেই থাকছিলেন। সেখানেই ঘুমের মধ্যে নীরবে চলে গেলেন তিনি।
স্বাধীনতার পর পারিবারিক ডব্লিউ রহমান জুট মিল রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলে আর্থিকভাবে বড় রকমের দুর্গতিতে পড়েছিলেন লতিফুর রহমান। নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে টেবিল-চেয়ার ভাড়া করে অফিস চালিয়েছেন। ধীরে ধীরে চায়ের ব্যবসা দিয়ে শুরু করে ট্রান্সকম গ্রুপের ১৬টি কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হয়েছিলেন তিনি।
লতিফুর রহমানকে সামনে রেখে আমরা প্রায় ২২ বছর ধরে গড়ে তুলেছি প্রথম আলো। ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলো প্রকাশিত হয়েছিল। বন্ধু ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামই উদ্যোগী হয়ে লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। তার আগে লতিফুর রহমানের সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ছিল।
তখন শামীম ভাইয়ের উৎসাহে আমরা কাগজটা বের করেছিলাম মাত্র দুই মাসের প্রস্তুতিতে। প্রকাশের প্রস্তুতি থেকে পত্রিকা বের হওয়া পর্যন্ত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিনি আমাদের সঙ্গে ছিলেন। যেদিন পত্রিকা বের হয়, সেদিনও রাতে ভাবিসহ তিনি ছিলেন সশরীরে। প্রেসে ছাপা পত্রিকা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ব্যাপক উত্তেজনার কথা কখনোই ভোলার মতো নয়।
শুরুতেই লতিফুর রহমান আমাদের লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন, প্রথম আলোকে দেশের এক নম্বর পত্রিকা হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। চলতে হবে নিজের আয়ে। সরকারের সব রকমের ট্যাক্স ও ভ্যাট ইত্যাদি দিতে হবে। প্রতিবছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে অফিসে আলোচনায় তিনি আমাদের পরবর্তী এক বছরের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিতেন।
দৈনিক সংবাদপত্রের সাংবাদিকতা, দৈনিক কাগজ কীভাবে চালাতে হয়, এর গুণ-মান, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, প্রচার ও বিক্রি, বিজ্ঞাপন থেকে আয় করা এবং ব্যবসায়িক দিক—সেসব সম্পর্কে আমাদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। এগুলো একটু একটু করে আমরা শেখার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। এভাবেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রথম আলোর যাত্রা ছিল বন্ধুর ও কঠিন। এক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে আমাদের। এখন ভাবতে বিস্ময় জাগে যে চার বছরের মধ্যেই আমরা এক নম্বর কাগজ হয়েছিলাম। দাঁড়িয়েছিলাম নিজের পায়ে। এরপর আর কখনো পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
এক দশক পর আমাদের জগৎ আরও বড় হলো। আস্তে আস্তে আমরা একাধিক মাসিক ম্যাগাজিন (কিশোর আলো, বিজ্ঞানচিন্তা, চলতি ঘটনা), ত্রৈমাসিক জার্নাল (প্রতিচিন্তা), প্রকাশনা সংস্থাসহ (প্রথমা) বহু কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছি। শামীম ভাই এসব বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। আর জুগিয়েছেন উৎসাহ। সব ক্ষেত্রেই সর্বাত্মক সহযোগিতা ছিল তাঁর।
আমরা জানি, দেশ-বিদেশে সাধারণভাবে সংবাদপত্রগুলো পরিচালিত হয় মালিকের নির্দেশে, তাঁদের হস্তক্ষেপে, তাঁদের জন্য। আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল এর বিপরীত। প্রথম আলো চালিয়েছি আমরা। প্রথম আলোর পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত—সব আমরাই নিয়েছি। লতিফুর রহমান সব সময় ছিলেন পেছনে। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদপত্র হিসেবে প্রথম আলোর সুনামের পেছনে এটিই সবচেয়ে বড় কারণ। ডেইলি স্টার–এর ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য।
প্রথম আলোর শুরুতে সরকারে ছিল আওয়ামী লীগ। তারপর যথাক্রমে বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তারপর আবার আওয়ামী লীগ। প্রতিটি সরকারের শাসনামলেই প্রথম আলোকে চাপের মধ্যে থাকতে হয়েছে, বহু রকম বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অন্য বহু সংকটও মোকাবিলা করতে হয়েছে। শুধু সরকারই নয়, সরকারবহির্ভূত মহল—কিছু ব্যবসায়ীসহ নানা অদৃশ্য শক্তি বিভিন্নভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
প্রায় ২২ বছর ধরেই এমন নানা উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পথপরিক্রমায় লতিফুর রহমান, আমাদের শামীম ভাই অভিভাবক ও বন্ধুর মতো আমাদের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন। একটি দিনও প্রথম আলোর কোনো সংবাদ বা মতামত প্রকাশ কিংবা অন্য কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেননি। প্রচ্ছন্নভাবেও সংবাদ ও মতপ্রকাশে কখনো কোনো বাধা দেননি। এ জন্যই প্রথম আলো হয়ে উঠতে পেরেছে বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্র।
প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবে শুধু নয়, প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজনে যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে শামীম ভাইয়ের সঙ্গে একটি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি প্রায়ই আমাদের অফিসে আসতেন, আমরাও যেতাম, গভীর রাতে বাসায় গল্প করতাম। তাঁর সঙ্গে, তাঁর পরিবারের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাঁর সততা, নিষ্ঠা ও সৌজন্য ছিল বিস্ময়কর। আমাদের সমাজে এমনটা খুব কম দেখা যায়।
মনে পড়ে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের নৃশংস হামলায় প্রিয় নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেন প্রাণ হারানোর পর ভীষণ ভেঙে পড়েছিলেন লতিফুর রহমান। ফারাজ তাঁর প্রিয় নাতি ছিল। তাকে নিয়ে বিদেশে গেছেন, বেড়িয়েছেন, আনন্দ করেছেন। ফারাজের মৃত্যুর পর তিনি নিজেকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিলেন।
ফারাজের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আগে তাঁদের পারিবারিক জীবনে আরও একটি ভয়ংকর বিপর্যয় ঘটেছিল। তাঁর ছোট মেয়ে শাজনীন নিজের বাড়িতেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ঘটনাটি তাঁকে প্রায় ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল। এটা অবিশ্বাস্য যে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় দুই দশক। দুই দশক পর সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দিয়েছিলেন।
লতিফুর রহমানের মেয়ে ফারাজের মা সিমিন হোসেন বলছিলেন, ‘প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আব্বু ফারাজের ছবি দেখে ঘুমাতে যেতেন। গতকাল রাতে ঘুমাতে গেলেন, আর জাগলেন না। কী অবাক বিস্ময়, একই দিনে চলে গিয়েছিল ফারাজও! তবে কি একই দিনে নাতি ফারাজই প্রিয় নানাকে ডেকে নিলেন নিজের কাছে? নাকি নানা লতিফুর রহমানই চলে গেলেন প্রিয় নাতির কাছে?’
তবে লতিফুর রহমান শারীরিকভাবে চলে গেলেও থেকে গেছেন আমাদের মধ্যে। প্রথম আলোর মধ্যে তাঁর স্বপ্ন রয়ে গেছে। লতিফুর রহমানের সমর্থন ও উদ্যোগই প্রথম আলোকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। এটা সত্য যে তিনি ছিলেন আমাদের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, কিন্তু আমরা তাঁকে পেয়েছি বন্ধুর মতো। নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত সব কর্মীর সঙ্গে আন্তরিকভাবে হাত মেলাতেন, তাঁদের খোঁজখবর নিতেন। তাঁর মৃত্যুতে তাই পুরো প্রথম আলো শোকাহত ও স্তব্ধ। আমরা প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর অভাব বোধ করব। আবার তাঁর প্রতি আমাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আবেগ নিয়েই প্রথম আলোকে এগিয়ে নেব আমরা। তিনি নেই; ভাবি শাহনাজ রহমান, মেয়ে সিমিন হোসেনসহ পরিবারের সবার জন্য আমাদের ভালোবাসা।