সমাজের নানা ক্ষেত্রে লতিফুর রহমানের অসামান্য অবদান আছে। কিন্তু স্বাধীন সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় তিনি যে অবদান রেখে গেছেন, সেদিকে আমি জোর দিতে চাই।
আমার মনে পড়ছে, ব্যাংককে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর বাসায় মাহ্ফুজ আনামের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। মাহ্ফুজ তখন দেশে একটি নতুন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে দেশে ফেরার কথা ভাবছিলেন। আমি তখন মাহ্ফুজকে বাংলাদেশে মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় বাধা মনে করিয়ে দিলাম। তাঁকে বললাম, ‘তুমি যে একটা স্বাধীন সংবাদপত্র করতে চাও, তাতে বিনিয়োগ করবে কে? তোমাকে তো নিশ্চিতভাবেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের কারও না কারও শরণাপন্ন হতে হবে। যে ব্যবসায়ীরা তোমাকে সংবাদপত্রটি চালু করতে অর্থ জোগান দেবেন, তাঁদের তো নিজেদের কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট অ্যাজেন্ডা থাকবে এবং সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সংবাদপত্রকে তাঁরা ব্যবহার করতে চাইবেন। তাঁদের দিক থেকে এই ধরনের চাপ এলে তা তুমি কীভাবে সামলাবে?’
এ বিষয়ে আমি মাহ্ফুজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি এবং পরেও কয়েকবার আলোচনার সময় তাকে ভারতের গণমাধ্যমের অবস্থা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছি, ভারতের প্রধান প্রধান সংবাদপত্র বড় বড় ব্যবসায়ী বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে চলে। সে দেশে সবচেয়ে বিখ্যাত ও ঐতিহাসিক সংবাদপত্রগুলোকেও সরকারবিরোধী মন্তব্যে লাগাম টেনে ধরার এবং সরকারের সমর্থনে কথা বলার জন্য প্রতিনিয়ত সরকারের দিক থেকে দিকনির্দেশনা ও চাপ আসে। বিশেষ করে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে জরুরি অবস্থা জারি করার পর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকা ছাড়া মূলধারার বিখ্যাত সব সংবাদপত্রই
তীব্র চাপের মুখে পড়ে গিয়েছিল। কারণ, পত্রিকার মালিকানায় থাকা ব্যবসায়ীদের এমন অনেক দুর্বলতা ছিল, যার ফলে তারা সরকারের চাপের মুখে নমনীয় থাকতে বাধ্য হতেন।
এ কারণে আমি মাহ্ফুজকে বলেছিলাম, পত্রিকা করতে গেলে সরকারের চাপ সামলাতে সক্ষম কোনো বিনিয়োগকারী পাওয়াটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একটি পত্রিকার জন্য তার স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে মনেপ্রাণে স্থির ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবেন—এমন একজন বিনিয়োগকারী খুঁজে বের করার চেয়ে সম্ভবত সুইয়ের ছিদ্র দিয়ে আস্ত একটা উট ঢোকানো অনেক সহজ ব্যাপার।
আনন্দের বিষয় হলো, মাহ্ফুজ আনাম লতিফুর রহমানের সঙ্গে আজিমুর রহমান এবং আজিমুর রহমানের স্ত্রী রোকিয়া আফজাল রহমানকেও বিনিয়োগকারী হিসেবে পাশে পেয়েছেন। আমি গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, তাই এটি আমার জন্য অনেক আনন্দের কথা এবং আমাদের প্রজন্মের জন্য একে একটি বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।
যে কারণে আজ সবাই লতিফুর রহমানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে, সেদিকে দৃষ্টিপাত করে সংবাদমাধ্যমে নতুন বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই, যদি আপনি সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বনির্ভর করে তুলতে চান, তাহলে প্রথমেই আপনাকে যেকোনো ধরনের চাপ থেকে নিজেকে আগে মুক্ত থাকার যোগ্য করে তুলুন।
আমরা এমন একটা যুগে বাস করছি, যখন শুধু বাংলাদেশেই নয়, দৃশ্যত দুনিয়ার সব দেশেই বেশির ভাগ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের ওপর চাপ আসার সুযোগ নিজেরাই তৈরি রাখে। হয় তারা কর দেওয়ার এমন প্রশ্নবিদ্ধ পন্থা বেছে নেয়, যা তাদের চাপে রাখার সুযোগ করে দেয়; নয়তো তারা তাদের ব্যাংকঋণ নেওয়া এবং দায়দেনার হিসাব পরিচালনার জন্য এমন পন্থা বেছে নেয়, যা তাদের চাপে রাখার সুযোগ করে দেয়; না হয় তারা এমনভাবে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে, যা দিয়ে তাদের চাপে রাখা যায়। তাদের সব সময়ই নিজেদের দুর্বলতা নিয়ে চলতে হয়। তখন পত্রিকাগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য আর সম্পাদকদের কাছে যেতে হয় না। সরকারের শুধু ওই পত্রিকার মালিকপক্ষকে ডেকে তাদের ট্যাক্স ফাইলের সমস্যা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ উপায়ে নেওয়া ঋণ এবং দায়দেনার বিষয়াদি সম্পর্কে মনে করিয়ে দিতে হয়। পত্রিকাকে চাপে রাখার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। ফলে যখন সম্পাদকেরা নিজেদের স্বাধীনতাকে উপভোগ করেন, তখন বুঝতে হয় যে তাঁদের এই স্বাধীনতার প্রকৃত উৎস হলো সংশ্লিষ্ট সেই পত্রিকার বিনিয়োগকারীর সততা, সুনাম, সাহস ও স্বাধীনতা।
সব সরকারই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যে ধরনের ভয় দেখানো কিংবা চাপে রাখার মতো আচরণের চর্চা করে থাকে, নিঃসন্দেহে লতিফুর রহমানকে সে ধরনের অসংখ্য চাপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। সরকারের দিক থেকে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারের ওপর যত চাপ ও বিরুদ্ধতা এসেছে, পর্দার অন্তরালে থেকে তিনি তা সামলেছেন। নইলে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার যেভাবে একের পর এক কয়েকটি সরকারের আমল পার করে এত দিন সুনামের সঙ্গে টিকে থাকতে পারত না। যে বিষয়টি লতিফুর রহমানকে এবং একই সঙ্গে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টারকেও অনন্য করেছে, তা হলো প্রতিটি সরকার বছরের পর বছর তাদের প্রতি বিরাগভাজন থেকেছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার নিজেদের দৃষ্টান্তমূলকভাবে স্বাধীন রাখতে পেরেছে। আর তার চেয়ে বেশি স্বাধীনচেতার পরিচয় দিয়ে গেছেন লতিফুর রহমান। আমরা জানি, যখনই কোনো খবর সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে, তখনই তাঁর ট্যাক্সের ফাইল চাওয়া হয়েছে এবং তাঁর আর্থিক বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। আর প্রতিবারই তিনি প্রবল সৎসাহস নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটি ছিল তাঁর অসামান্য ও ঐতিহাসিক অবদান। তাঁর প্রতি আমাদের অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মূল কারণ তাঁর সততা ও নীতির ক্ষেত্রে আপসহীনতা।
আয়নায় প্রতিফলিত ছবির মতো ব্যবসায়ীদের সততা তাঁদের ব্যবসায়িক চর্চার মধ্যে ধরা পড়ে। বেশির ভাগ ব্যবসায়ী সরকারি চাপের সামনে ন্যুব্জ হয়ে থাকেন। তাঁদের অনেকেই ঠিকমতো সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশন স্টেশন চালাতে পারেন না। এর মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতার মাত্রার পাশাপাশি ওই সব সংবাদমাধ্যমের বিনিয়োগকারীদের দুর্বলতার মাত্রাও প্রকাশ পেয়ে যায়। লতিফুর রহমান দীর্ঘ সময় ধরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় নীরবে ভূমিকা রেখে গেছেন। আমাদের সমসাময়িক ব্যবসায়িক সংস্কৃতিতে তিনি সততার মধ্য দিয়ে প্রায় একটি অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়ে গেছেন। এটি নিয়ে অনেকবার তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি আমাকে বলতেন, ‘এটিই আমার ব্যবসার অন্যতম নীতি। আমার যেহেতু সংবাদপত্র আছে, সেহেতু সংবাদপত্রকে ঝুঁকির হাত থেকে বাঁচাতে হলে নিজেকে স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।’ তিনি তাঁর নিজের কোনো অ্যাজেন্ডা পত্রিকার ওপর কখনো চাপিয়ে দেননি, বরং পত্রিকা দুটির বোঝা ও দায় সম্পাদকদের ওপর না চাপিয়ে তা নিজের কাঁধে নিয়েছেন। এসব কথা তিনি ঢাকঢোল পিটিয়ে দুনিয়াকে জানাননি, কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠরা এটি জানতেন।
লতিফুর রহমানের আদর্শের আরেকটি অনন্য দিক ছিল। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা চাইতে হবে, এমন যেকোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে নিজেকে তিনি দূরে রাখতেন। এটি ব্যবসায়িক সংস্কৃতির একটি গুণগত দিক। তিনি মনে করতেন, যে মুহূর্তে আপনি সরকারের সহায়তা নেবেন, ঠিক সে মুহূর্তেই আপনার নিজের মত ও স্বাধীনতা দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি এমন মূল্যবোধ লালন করতেন, যার মূল্যায়ন টাকা দিয়ে হয় না। স্বাধীন গণমাধ্যমের স্বার্থে তিনি যে ছাড় দিয়েছেন, তার কোনো বাজারমূল্য হয় না। তিনি সংবাদমাধ্যমের বিনিয়োগকারীদের এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য একটা মান দাঁড় করিয়ে গেছেন। তিনি তাদের জন্য এই শিক্ষা রেখে গেছেন যে একজন মুক্ত ও স্বাধীন ব্যবসায়ী হতে চাইলে শেষ পর্যন্ত আপনাকে ব্যবসায়িক সততা প্রমাণ করতেই হবে, যা আপনাকে সব ধরনের দুর্বলতা থেকে মুক্ত রাখবে।
এসব গুণের স্বীকৃতি লতিফুর রহমান শুধু তাঁর সতীর্থ সহকর্মীদের কাছ থেকেই পাননি; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী যে পাঠকেরা সংবাদপত্র পড়েন, তাঁদের কাছ থেকেও পেয়েছেন। এই প্রদর্শনপ্রবণ সমাজে অকস্মাৎ অসীম সম্পদের অধিকারী হয়ে যাওয়া নব্য সামন্তবাদী অভিজাত শ্রেণির মধ্যে যে সহজাত অহংকার দেখা যায়, তিনি তার থেকে দূরে থাকতেন। তিনি নিজে প্রাচুর্যের চূড়ায় থাকার পরও মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় তাঁর কোনো আচরণে প্রাচুর্যের অহংকার প্রদর্শন করতেন না। বিনয় ও নম্রতা তাঁকে অসামান্য মানবিক মানুষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল।
তিনি তাঁর উত্তরসূরিদের সামনে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ রেখে গেছেন। তিনি যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, তা রক্ষা করার মহান দায়িত্ব তাঁদের ওপর পড়েছে। তিনি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, সেটি ধরে রাখা গেলে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁর সে আদর্শ পৌঁছে দেওয়া গেলেই তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে রোল মডেল হয়ে থাকবেন। তিনি যে দুটি সংবাদপত্র সৃষ্টি করে গেছেন, তা সাংবাদিকদের কাছে রেখে যাওয়া তাঁর মহান উত্তরাধিকার। এই সংবাদপত্রের জন্য তাঁকে কোন পরিবেশে থেকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে, সেটি তাঁর উত্তরসূরিদের স্মরণে রাখতে হবে। তাহলে শুধু তাঁর প্রতিই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দায়িত্ববোধ বাড়বে না, বরং সমগ্র স্বাধীন গণমাধ্যমের ধারণার প্রতিও নিজেদের শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে।
লতিফুর রহমান বয়সে আমার অনেক কনিষ্ঠ হলেও আমাদের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে বলতেন, আমাদের নানা বিষয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু আমাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বোধও অনেক জোরালো। তাঁর কথাকে আমি স্বাগত জানিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, আগামী দিনগুলোতেও তা আমার মনে থাকবে।
আমি আবার তাঁর প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। আসুন আমরা তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও ঐতিহ্যের চর্চাকে ধরে রেখে তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাই। কারণ, মানুষ মৃত্যুবরণ করে, স্বজনেরা গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে বিস্মৃতি তাদের আড়াল করতে থাকে। প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার যদি তাঁর রেখে যাওয়া নীতি ও ঐতিহ্য ধরে রেখে তাঁকে যথার্থ মর্যাদা দিয়ে যেতে পারে, সেটিই হবে তাঁকে স্মরণ করার সবচেয়ে ভালো উপায়।
লতিফুর রহমান স্মরণে ১৪ জুলাই ২০২০ তারিখে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার আয়োজিত ‘স্মৃতি ও কৃতি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সভায় দেওয়া বক্তব্যের পরিমার্জিত