প্রায় দুই দশক আগের কথা। বিজ্ঞাপন বোঝা, ক্লায়েন্টকে লে-আউট দেখানো আর সেটা যদি কোনো কারণে ক্লায়েন্টের পছন্দ না হতো, তা হজম করতে করতে তখন ১৮ ঘণ্টা সময় কেটে যেত। সেই সময়টায় একদিন আমার প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে বসে কাজ করছি, দুই দিন পর একটা প্রেজেন্টেশন আছে, তারই প্রস্তুতি। দুই সপ্তাহ ধরে যে স্লাইড তৈরি করেছি তার সংখ্যা প্রায় ১৫০, যা তিনি শুরুতেই তা ৫০–এ নামিয়ে আনলেন। বললেন, আমরা যাঁর কাছে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করব, তিনি একজন কম কথার মানুষ।
দুদিন পর যখন প্রেজেন্টেশনের জন্য গেলাম, তখন আমার প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কথার যথার্থতা খুঁজে পেলাম মিটিংজুড়ে হেড টেবিলে বসে থাকা অসম্ভব রাশভারী মানুষটাকে দেখে। তিনি এমনই কম কথা বললেন যে তাঁর মুখাবয়ব, টুকটাক আকার-ইঙ্গিত ছাড়া পুরো মিটিংয়ে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তিন ঘণ্টার মিটিং শেষে তিনি জানতে চাইলেন, কত তাড়াতাড়ি কাজগুলো শুরু করা যাবে। এতে বুঝতে পারলাম, এই নিপাট ভদ্রলোক একদমই সময় নষ্ট করেন না। পরে তাঁরই একজন জুনিয়র সহকর্মীর কাছে জানতে পেরেছি বিজ্ঞাপনের কাজের প্রতি তাঁর বাড়তি উৎসাহের কথা। তিনি অত্যন্ত মনোযোগ আর ভালোবাসা দিয়ে কাজগুলো দেখেন এবং মূল্যায়ন করেন। আমাদের মতো যারা এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি ওনার আলাদা একটা ভালোবাসা রয়েছে। তখন এও জানলাম, তিনি বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনশিল্পের প্রথম দিককার একজন উদ্যোক্তা। তখন থেকেই এই মানুষটির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ২০ বছর ধরে নানাভাবে ওনাকে দেখেছি।
পারিবারিকভাবে শিল্প-বাণিজ্যে তাঁর পরিবারের প্রায় ১০০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলেও, তাঁর ধারাটি তিনি সাজিয়েছিলেন নিজের মতো করে। তাঁর অত্যন্ত পছন্দের একটি গানে অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর জীবন আদর্শের। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার গানটির প্রথম কয়েকটি লাইন এ রকম;
অ্যান্ড নাউ দা এন্ড ইজ নিয়ার
অ্যান্ড সো আই ফেইস দা ফাইনাল কার্টেন
মাই ফ্রেন্ডস আই উইল সে ইট ক্লিয়ার
আই উইল স্টেইট মাই কেস অব হুইচ আই এম সার্টেন
আই হ্যাভ লিডস এ লাইফ দেটস ফুল
আই হ্যাভ ট্রাভেলড ইচ অ্যান্ড এভরি হাইওয়ে
অ্যান্ড মোর, মাচ মোর দ্যান দিস
আই ডিড ইট মাই ওয়ে
আসলেই তো তিনি তাঁর নিজস্ব জীবনদর্শনকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে। পাঁচ দশকের বেশি সময় তাঁকে যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তার জন্য নালিশ করেননি কাউকে আর সাফল্য প্রাপ্তির চূড়ায় থেকেও অতি উচ্ছ্বসিত হননি। কারণ, এই দীর্ঘ যাত্রায় তাঁর চিরন্তন সঙ্গী ছিলেন তাঁর সহধর্মিণী, সুখ–দুঃখে, আনন্দ-বেদনায় এই প্রবাদপুরুষের সঙ্গে। অনেকগুলো সফল প্রতিষ্ঠান ছাড়াও একসঙ্গে তাঁরা দুজন মিলে খুব সফলভাবে আরেকটি কাজ করেছিলেন তা হলো, পরিবারের কাঠামোটিকে জোরদার করা। চারজন সন্তান, তাঁদের পরিবার এবং নাতিদের নিয়ে তিনি একটি অসম্ভব সুন্দর পারিবারিক বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন। সঙ্গে ছিল আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। যেকোনো পরিস্থিতিতে একসঙ্গে থাকার এক অনবদ্য উদাহরণ।
এই পরিবার ছিল তাঁর কাছে সবকিছু। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনে তিনি বপন করেছেন দেশপ্রেমের বীজ। কারণ, তিনি নিজেও সব সময়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। দেশকে নিয়ে ছিল তাঁর অনেক গর্ব। সারা পৃথিবী ঘোরা মানুষটি তাই তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়ে গেছেন তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মভূমি কুমিল্লায়। তিনি শেষনিশ্বাসও ত্যাগ করেছেন সেখানে। প্রিয় পাঠক, আমি এতক্ষণ জীবনের চেয়েও বড় যে মানুষটি কথা বললাম, তিনি জনাব লতিফুর রহমান। কাছের মানুষেরা যাঁকে ভালোবেসে শামিম বলে ডাকতেন।
এ জেড এম সাইফ: বিজ্ঞাপনী সংস্থা পেপার রাইমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।