আমরা যথেষ্ট অবস্থাপন্নই ছিলাম। আমার দাদার চা-বাগানটি ছিল এই অঞ্চলে স্থানীয় কারও মালিকানায় প্রথম বাগান। বাবার বড় পাটের ব্যবসা ছিল। পাটকলও করেছিলেন। সেই ১৭ বছর বয়সে আমার নিজেরই একটা গাড়ি ছিল, ফিয়াট। তার পরও জীবনের আরেকটি দিক আমার দেখা হয়েছে।
জীবনে একটা সময় এসেছিল, যখন আমাদের কাছে নগদ এক শ টাকাও ছিল না। সেই জীবন থেকে আবার ঘুরেও দাঁড়িয়েছি। তারপর কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের অগ্রগতি আর আমার ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ যেমন প্রায় শূন্য থেকে শুরু করেছে, আমাকেও নতুন করে শুরু করতে হয়েছে তখন থেকেই।
যে ট্রান্সকম গ্রুপকে কেন্দ্র করে আমরা এগিয়ে চলেছি, তার ভিত কিন্তু গড়ে উঠেছিল সেই ১৮৮৫ সালে, আমার দাদার হাত ধরে। আমার দাদা খান বাহাদুর ওয়ালিউর রহমান। তাঁর জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের চিওড়া গ্রামে। তবে দাদার শৈশব কেটেছে জলপাইগুড়িতে, মামার কাছে। সেখানেই আইন পাস করে আইনি পেশা শুরু করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে তিনি সেখানে কিছু জমি কিনে চা-বাগান শুরু করেন। তখন চা-বাগানের মালিক ছিল মূলত ব্রিটিশরা। জলপাইগুড়িতে জন্ম হলেও আমার বাবা মুজিবুর রহমান লেখাপড়া করেন কলকাতায়। সেখান থেকে আসামের তেজপুরে ফিরে নিজেই জমি কিনে চা-বাগান তৈরি করেন। আমার খান বাহাদুর উপাধি পাওয়া বাবা দেশভাগের পর সবাইকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। এরপর সিলেটে নতুন করে চা-বাগান করার পাশাপাশি শুরু করেন পাটের ব্যবসা।
আমার জন্ম ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট, জলপাইগুড়িতে। ঢাকায় আমাদের বাসা ছিল গেন্ডারিয়ায়। ১৯৫৬ সালে বাবা আমাকে পাঠিয়ে দেন শিলংয়ের সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে। সেখান থেকে চলে যাই কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তবে ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—এসব কারণে ঢাকায় ফিরে এসে বাবার পাটের ব্যবসায় যুক্ত হই। তখন চাঁদপুরে ডব্লিউ রহমান জুট মিল নামে আমাদের একটি পাটকল ছিল। ১৯৬৬ সালে সেখানে কাজ শুরু করি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এভাবে কাজ করার পর শুরু হয় আমার জীবনের আরেক অধ্যায়।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে চা-শিল্প ছাড়া সবকিছুই জাতীয়করণ করা হয়। মালিকানা ব্রিটিশদের হাতে বেশি ছিল বলেই জাতীয়করণের আওতায় চা-শিল্প পড়েনি। এর আগ পর্যন্ত চা পুরোটাই চলে যেত পশ্চিম পাকিস্তানে। সেই বাজার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। ফলে চা-বাগান থাকলেও খুব একটা লাভ হলো না। অন্য দেশে কীভাবে চা রপ্তানি করতে হয়, তাও জানতাম না। বিক্রি করতে না পারার কারণে চা গুদামে পড়ে ছিল। আমাদের অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে গেল। আমরা নগদ অর্থের চরম সংকটে পড়লাম। অত্যন্ত অবস্থাপন্ন অবস্থায় থেকেও হঠাৎ করে সবকিছু চলে যাওয়াটা জীবনে প্রথম দেখলাম। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা, যা আমার পরবর্তী জীবনে কাজে লেগেছে।
আমার অফিস তখন ৫২ মতিঝিলে। জাতীয়করণ হওয়ায় অফিসের আসবাবও সরকারের হয়ে গেল। কিছু আসবাব ভাড়া করলাম। এমনকি ঘর থেকে পাখা খুলে এনে লাগাতে হলো অফিসে। মনে আছে, ১৯৭২ সালের শেষ দিকে একজন সুইস ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়। নাম রেনে বারনার। আমার সঙ্গে চা-বাগানে গিয়ে তিনি স্তূপাকারে পড়ে থাকা চা দেখলেন। এরপর দেশে ফিরে গিয়ে চা কেনার আগ্রহের কথা জানালেন। তখন পণ্যের বিনিময়ে পণ্য, অর্থাৎ বার্টার বা কাউন্টার ট্রেডের ব্যবস্থা ছিল। বাংলাদেশে তখন কীটনাশকের প্রচুর চাহিদা। রেনে বারনার চায়ের সঙ্গে কীটনাশকের বার্টার ট্রেডের প্রস্তাব দিলেন। এ জন্য অনুমতি লাগত। দেখা করলাম তখনকার বাণিজ্যমন্ত্রী এম আর সিদ্দিকীর সঙ্গে। সচিবালয় ঘুরে ঘুরে অনুমতি আনলাম। এভাবেই শুরু হলো চা রপ্তানি। এর জন্য টি হোল্ডিংস লিমিটেড গঠন করা হলো। এভাবে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে শুরু করলাম।
সময়টা ছিল ১৯৭৩। নগদ অর্থের সংকট কিন্তু তখনো কাটেনি। নেদারল্যান্ডসের রটারডাম-ভিত্তিক ভ্যান রিস সে সময়ে বিশ্বে অন্যতম চা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। আমরা তাদের কাছে চা সরবরাহ করতে চাইলাম। এ জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। উত্তরা ব্যাংকের কাছে ৫০ লাখ টাকার ঋণের আবেদন করলাম। ব্যাংক এ জন্য ঋণের মার্জিন ২০ শতাংশ নির্ধারণ করে দিল। উত্তরা ব্যাংকের এমডি ছিলেন মুশফিকুস সালেহীন। আমি তাঁর কাছে গেলাম। তিনি আমার বাবাকে চিনতেন। বললেন ১০ শতাংশ মার্জিন দিতে। আমি বললাম, ‘আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমি এক টাকাও মার্জিন দিতে পারব না।’ তিনি তা মেনে নিয়েছিলেন।
সেই ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে নতুন করে চা ব্যবসা সাজালাম। শুরু হলো আবার পথচলা। সেই পথচলা আর কখনো থেমে যায়নি। কখনো আর পেছনে ফিরে তাকাতেও হয়নি। আমার জীবনে সেটাই ছিল মোড় ফেরানো ঘটনা। এই ঘটনা থেকেও আরও একটি শিক্ষা নিলাম যে স্থায়ী সম্পদে বড় কোনো বিনিয়োগ করব না। কারণ, নগদ অর্থ যেকোনো সময় নেই হয়ে যেতে পারে। ফলে বড় কোনো ভবন আমি আর বানাইনি। জমি কিনেও বসে থাকিনি। আবার কেবল বাণিজ্যেও ব্যস্ত থাকিনি। বরং শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়েছি। ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রাখা আমার পছন্দ নয়। তাহলে তো টাকা কোনো কাজেই লাগল না। আমি টাকা বিনিয়োগ করতে পছন্দ করি। আমি আমার পছন্দের কাজটা করে চলেছি।নিজের দেশের প্রতি আমার একটা অঙ্গীকার ও ভালোবাসা আছে। আমার কখনো মনেই হয়নি যে আমি অন্য দেশে থাকব। আমি ভাবিনি, আমার সন্তানেরাও নয়। এমনকি আমার নাতিরা যারা অন্য দেশে পড়াশোনা করছে, তারাও সেখানে থেকে যেতে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। আমাদের সবার একটাই পাসপোর্ট, এই বাংলাদেশের। আমাদের এই বাংলাদেশকে নিয়ে অনেকেই হতাশার কথা বলেন। আমি একেবারেই হতাশ নই। আমার চোখের সামনে এই দেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। অনেক এগিয়েছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিভক্তি, অবকাঠামোর সমস্যা, দুর্নীতি—এসব না থাকলে হয়তো আরও উন্নতি হতো। কিন্তু আমি আশাবাদী।
প্রতিষ্ঠান চালানোর ক্ষেত্রে আমরা কিছু বিষয় মেনে চলি। যেমন আমি সবাইকে স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠান চালাবার ক্ষমতা দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁদেরই। তবে আমি যেটা খুব ভালোভাবে করি, তা হলো আর্থিক নিয়ন্ত্রণ। আমি সেটা কঠোরভাবে অনুসরণ করি। গ্রুপের প্রতিটি কোম্পানির হিসাব ও আর্থিক বিবরণী পরের মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাঠাতে হয়। সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করি। কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে তাও নিই। এটি আমাদের সাফল্যের একটি বড় কারণ। আর দীর্ঘমেয়াদে সফলতার জন্য প্রয়োজন হলো দেশের আইন-কানুন মেনে ও নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করা। আমি যদি আমার কোনো কর্মকর্তাকে অনৈতিক কিছু করতে বলি, তাহলে তো সেও একই কাজ করবে। এতে হয়তো দ্রুত ধনী হওয়া যাবে, কিন্তু প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারবে না।
আমার গ্রুপের আরেকটি বড় সাফল্য হচ্ছে, আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানেই কোনো বিদেশি কাজ করে না। সবাই বাংলাদেশি। আমাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি কেএফসি বা পিৎজা হাট এশিয়ার সেরা হয়েছে, আমাদের পেপসি সেরা বটলারের স্বীকৃতি পেয়েছে। এগুলো বাংলাদেশিরাই চালাচ্ছেন। তাঁদের নিয়েই তো আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাফল্য পেয়েছি। তবে আরও এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে আমাদের ইংরেজির মান আরও বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতি উন্নতও হয়েছে।
আমি কিন্তু আমাদের দেশের আসল নায়ক মনে করি কৃষকদের। দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড কৃষি, আর এর সাফল্য কৃষকদের। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, হরতাল-ধর্মঘট নেই, তাঁরা পুরো দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করেই চলেছেন।
প্রবাসী শ্রমিকেরা আমাদের আরেক নায়ক। তাঁদের পাঠানো প্রবাসী আয় টিকিয়ে রাখছে আমাদের অর্থনীতিকে। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশ্রমিকেরা কাজ করতে পারছেন বলেই তো অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে। অভ্যন্তরীণ চাহিদাই অর্থনীতির বড় শক্তি, যা ভারতের আছে, চীনেরও আছে। আমাদেরও অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির পরিমাণ বাড়ছে। এটি আরও বাড়াতে হবে।
সব মিলিয়ে, আমি আমার এই দেশটা নিয়ে, দেশের তরুণদের নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী। দেশ এগিয়ে যাবেই।
প্রথম আলো